যা যা আছে

আলোকবিদ্যার ইতিকথা -
আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের সূচনা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

মূল ছবি: সুনন্দ

এর পর আমাদের মধ্যযুগ ছেড়ে আধুনিক যুগে আসার সময় হয়েছে। ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩—১৫৪৩ খ্রি) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ De Revolutionibus Orbium Coelestium প্রকাশ করেন; সেখানে তিনি সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের প্রস্তাব করেন। এর সঙ্গে সঙ্গেই বিজ্ঞানে আধুনিক যুগের সূচনা হল ধরে নেওয়া যায়। এর পরেই যে দুই বিখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম আসে তাঁরা হলেন জোহানেস কেপলার (১৫৭১—১৬৩০ খ্রি) ও গ্যালিলিও গ্যালিলি (১৫৬৮—১৬৪২ খ্রি)।

গ্রহদের গতিবিধি সংক্রান্ত কেপলারের সূত্রের কথা আমরা সবাই জানি। কেপলার ১৬০০ সালের ১০ জুলাই সূচীছিদ্র ক্যামেরার সাহায্যে সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। অ্যারিস্টটলের লেখাতে উল্লেখ থাকলেও, ইউরোপে সেই ক্যামেরার ধারণা আল হাইথামের লেখা থেকেই এসেছিল। কয়েকবছর আগে টাইকো ব্রাহে (১৫৪৬—১৬০১ খ্রি) দেখেছিলেন যে খালি চোখে রাতের আকাশে চাঁদকে যত বড় মনে হয়, সূচীছিদ্র ক্যামেরার সাহায্যে সূর্যগ্রহণের সময় পর্যবেক্ষণ করলে তার থেকে বড় দেখায়। কেপলার বুঝলেন, ক্যামেরার ছিদ্রটি পুরোপুরি বিন্দু নয়; বিন্দুর মতো ছিদ্র বাস্তবে সম্ভব নয়। সেই কারণেই চাঁদের প্রতিবিম্ব তার থেকে বড় মনে হয়। তিনি পরীক্ষামূলকভাবে সূচীছিদ্রের মধ্যে দিয়ে আলোকউৎস থেকে কেমনভাবে আলো যায়—তা নির্ণয় করেছিলেন। কেপলার এও বলেছিলেন, যে আমাদের চোখ সূচীছিদ্র ক্যামেরার মতো কাজ করে। ১৬০৪ সালে তিনি দৃষ্টি বিষয়ে তাঁর গবেষণা প্রকাশ করেছিলেন। গ্যালিলিও দূরবিন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিখ্যাত। তাঁর পরেই যিনি দূরবিন ব্যবহার করতে সে যুগের বিজ্ঞানীদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তিনি কেপলার, যদিও জীবনে কখনো তিনি দূরবিন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করেননি। কারণ তাঁর দৃষ্টিশক্তি ছিল খুবই খারাপ। আলোকবিদ্যাতে সেই যুগে তাঁর মতো পণ্ডিত আর কেউ ছিলেন না। গ্যালিলিও নানা রকম চেষ্টা করে ট্রায়াল অ্যান্ড এরর বা শুদ্ধাশুদ্ধি পদ্ধতিতে দূরবিনের উন্নতি করেছিলেন। কেপলার তাত্ত্বিকভাবে দূরবিনের কার্যপ্রণালীর দিকে মন দিলেন। প্রথম যুগের দূরবিনে লেন্স ব্যবহার করা হত। লেন্সের একটা প্রধান সমস্যা হল গোলীয় অপেরণ (spherical aberration)। লেন্স সাধারণত গোলকের অংশ, কারণ সেইভাবে তাকে বানানো সহজ। কিন্তু গোলীয় লেন্সে প্রতিবিম্ব একটু ঝাপসা হয় কারণ সমান্তরাল আলোকরশ্মিগুচ্ছ ঠিক এক বিন্দুতে মিলিত হয় না। চোখের গোলীয় অপেরণ খুব কম, কেপলার আগেই দৃষ্টি বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন। তিনি চোখের লেন্সের আকৃতি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত করলেন যে লেন্সের আকৃতি গোলীয় থেকে একটু আলাদা হতে হবে। আমরা এখন জানি যে লেন্সের আকার হওয়া উচিত অধিবৃত্তাকার (paraboloid)। তবে সেই যুগে এই আকার বানানো সম্ভব ছিল না। গ্যালিলিওর দূরবিনে ছিল একটি অভিসারী বা উত্তল ও একটি অপসারী বা অবতল লেন্স। কেপলার দুটি উত্তল লেন্স দিয়ে দূরবিন বানানোর কথা বললেন, এবং দূরবিনকে আরো লম্বা করার পরামর্শ দেন।

একরঙা, বিন্দু-উৎস থেকে আসা আলোর গোলীয় অপেরণের সিম্যুলেশন। উপরের সারিতে অপেরণকে অর্ধেক তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিমাণ বেশি সংশোধন করা হয়েছে, নীচের সারিতে অর্ধেক তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম। মাঝের সারিতে কোনো সংশধন হয়নি। বাঁদিক থেকে ডানদিকের থামে ফোকাসের ভেতর থেকে ক্রমাগত বাইরে যাওয়া হয়েছে, মাঝের থাম নিখুঁত ফোকাসে। (উৎস: উইকি)

গোলীয় অপেরণের ভিডিও (উৎস: ইউটিউব)

গ্যালিলিওর দূরবিনে আধুনিক বাইনোকুলারের মতো বস্তুর প্রতিবিম্ব সোজাই থাকত। কেপলারের দূরবিনে প্রতিচ্ছবি উল্টে যায়। জ্যোতিষ্কদের ক্ষেত্রে সোজা বা উল্টো প্রতিবিম্বের জন্য কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু কেপলারের দূরবিনে বিবর্ধন অনেক বেশি করা যায়। ক্যামেরা বা রাইফেলের গানসাইট ইত্যাদিতে যে ক্রসহেয়ার থাকে, যার সাহায্যে সঠিক দিকে তাক করা যায়—কেপলারের দূরবিনে সেটা ব্যবহার করা খুব সোজা। তার সাহায্যে প্রতিবিম্বের অবস্থান খুব নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা যায়। সেই কারণে জ্যোতির্বিদরা আস্তে আস্তে কেপলারের দূরবিন ব্যবহার শুরু করেন। আগেই বলেছি, প্রাচীন গ্রিক বিজ্ঞানীরা সাধারণত ধরে নিয়েছিলেন যে আলোর বেগ অসীম। আল হাইথাম বা ইবন সিনা তাঁদের মতের বিরোধিতা করেছিলেন। ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দের বইতে কেপলার লিখেছিলেন, যে আলোর বেগ অসীম।

জোহানেস কেপলার (উৎস: উইকি)
ফ্লোরেন্সের গ্যালিলেও জাদুঘরে রাখা গ্যালিলেওর টেলিস্কোপ (উৎস: উইকি)

গ্যালিলিওকে বলা হয় আধুনিক পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের জনক; তিনিই প্রথম আলোর বেগ মাপার চেষ্টা করেন। একটি পাহাড়ের উপরে একজন ব্যক্তি হঠাৎ একটি লণ্ঠনের উপর থেকে ঢাকা সরিয়ে দিল, দূরের পাহাড়ের উপর থেকে তার সহকারী—আলো দেখামাত্র—অপর একটি লণ্ঠন থেকে ঢাকা সরিয়ে দেবে। প্রথম ব্যক্তি প্রথমবার লন্ঠনের ঢাকা সরানো ও সহকারীর আলো দেখার মধ্যে সময়ের পার্থক্য মাপবেন, তারপরে দুই পাহাড়ের মধ্যের দূরত্ব ও সময়ের পার্থক্য থেকে আলোর বেগ বার করবেন। গ্যালিলিও লিখেছেন যে তিনি পরীক্ষা করে আলোর বেগ নির্ণয় করতে পারেননি, কারণ সময়ের পার্থক্য এতই কম, যে তা মাপা যায়নি। তবে বোঝা গেল, যে আলোর বেগ অনেক বেশি।

আলোর বেগের মান প্রথম মোটামুটিভাবে নির্ণয় করেছিলেন ডেনমার্কের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওলে রয়মার (১৬৪৪—১৭১০ খ্রি)। তিনি বৃহস্পতির উপগ্রহগুলির গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। গ্যালিলিও প্রথম বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যবেক্ষণ করলে গ্রহণের সময় আলাদা আলাদা হবে, ঠিক যেমন সূর্যগ্রহণ যে সমস্ত জায়গা থেকে দেখা যায়, সেখানে আলাদা আলাদা সময়ে সূর্যগ্রহণ শুরু হয়। গ্যালিলিও প্রস্তাব করেছিলেন, যে, কোনো জায়গা থেকে বৃহস্পতির উপগ্রহদের গ্রহণের সময় জানলে সেখানকার দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় সম্ভব। সেই যুগে, বিশেষ করে মাঝসমুদ্রে জাহাজ থেকে অবস্থান বার করা ছিল প্রায় অসম্ভব। গ্যালিলিওর পদ্ধতি সমুদ্রে বিশেষ কাজে লাগেনি, ঢেউয়ে দুলতে থাকা জাহাজের ডেক থেকে গ্রহণের সঠিক সময় বার করা যাচ্ছিল না। তবে শুকনো ডাঙাতে গ্যালিলিওর পরামর্শ কাজে এসেছিল। রয়মার ডেনমার্কের ভেন দ্বীপ ও ফ্রান্সের প্যারি থেকে বৃহস্পতির উপগ্রহদের গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তিনি দেখলেন যে পৃথিবী যখন বৃহস্পতির থেকে দূরে সরে যায়, তখন দুই গ্রহণের মধ্যের সময়কাল বাড়তে থাকে। আবার যখন পৃথিবী বৃহস্পতির দিকে যায়, তখন সেটা কমে যায়। তিনি বললেন, এর কারণ—বৃহস্পতি যখন পৃথিবীর কাছে থাকে, তখন আলো পৃথিবীতে আসতে অপেক্ষাকৃত কম সময় নেয়, দূরে থাকলে বেশি সময় লাগে। ১৬৭৬–৭৭ সাল নাগাদ তিনি হিসাব করে বললেন, যে আলো পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাসের সমান দূরত্ব পেরোতে বাইশ মিনিট সময় নেয়। এই অধ্যায়ের পরিশিষ্টে এই নিয়ে আরো আলোচনা আছে।

আকাশ পর্যবেক্ষণরত রয়মার (উৎস: উইকি)

রয়মার নিজে কখনো আলোর বেগের কোনো নির্দিষ্ট মান দেননি। তার কয়েক বছর আগে জিওভান্নি ক্যাসিনি (১৬২৫—১৭১২ খ্রি) সূর্য থেকে মঙ্গলগ্রহের দূরত্ব নির্ণয় করেছিলেন। গ্রহদের গতিবিধি সংক্রান্ত কেপলারের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী, কোনো গ্রহের পরিক্রমণকালের বর্গ সূর্য থেকে তার দূরত্বের ঘনের সমানুপাতী। সেই সূত্র ব্যবহার করে একটি গ্রহের দূরত্ব জানলেই বাকি সমস্ত গ্রহের দূরত্ব জানা যায়। সেইভাবে পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাস মোটামুটি জানা ছিল। ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স (১৬২৯—১৬৮৫ খ্রি) হিসাব করে দেখলেন, যে আলোর বেগ হল সেকেন্ডে 2,20,000 কিলোমিটারের কাছাকাছি। আমরা এখন জানি, যে আলোর বেগ হল সেকেন্ডে 2,99,792 কিলোমিটার—রয়মার ও হাইগেন্সের মাপ তার থেকে কিছুটা কম হলেও অন্তত কাছাকাছি পৌঁছেছিল।

রয়মারের পঞ্চাশ বছর পরে ১৭২৮ সালে বিজ্ঞানী ও দূরবিন নির্মাতা জেমস ব্র্যাডলি (১৬৯২—১৭৬২ খ্রি) নক্ষত্রের অপেরণ (Stellar aberration) পর্যবেক্ষণ করে আলোর বেগ নির্ণয় করেছিলেন। তিনি বেগ নির্ণয় করেছিলেন 3,01,০০০ কিলোমিটার, আধুনিক মাপের খুব কাছাকাছি। কেমনভাবে ব্র্যাডলি এই মাপ পেয়েছিলেন, তা নিয়ে পরিশিষ্টে আলোচনা আছে। আলোর বেগ পদার্থবিজ্ঞানে এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তার প্রসঙ্গে আমরা পরে আবার আসব।

আলোকবিদ্যা প্রসঙ্গে আর এক প্রতিভার নাম আসে, তিনি লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪৫২—১৫১৯ খ্রি)। লিওনার্দো বিজ্ঞানে বিপ্লবের আগের যুগের মানুষ, শিল্পী হিসাবেই তিনি সাধারণভাবে বেশি পরিচিত, কিন্তু তাঁর নোটবুক থেকে দেখা যায় যে প্রযুক্তিবিদ হিসাবেও তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ। চিত্রকলার বিষয়ে চিন্তা প্রসঙ্গেই তিনি আলো নিয়ে তাঁর মতামত লিখে গেছেন নোটবইতে। সেখানে তিনি লিখেছেন যে আলো চোখ থেকে বেরোনো সম্ভব নয়। তার কারণ হিসাবে তিনি বলছেন যে আলোর বেগ অসীম নয়। আমরা পরে দেখব যে আলো হল একপ্রকার তরঙ্গ, সেই কথা প্রথম বলেছিলেন ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স। তার এক শতাব্দী আগেই লিওনার্দো জলের উপরের ঢেউ বা তরঙ্গের সঙ্গে আলোর তুলনা করেছেন। ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ মনে করেন যে হাইগেন্স লিওনার্দো দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন; হাইগেন্সের এক চিঠিতে আছে যে তিনি লিওনার্দোর আলোকবিদ্যা বিষয়ে এক পাণ্ডুলিপি কিনেছেন। আমরা আগে দেখেছি—হিরো প্রতিফলন ব্যাখ্যা করতে ধরে নিয়েছিলেন, যে আলো সব সময় সব থেকে কম দূরত্বের পথে যায়, কিন্তু তা বিজ্ঞানীরা ভুলে গিয়েছিলেন। লিওনার্দোর লেখাতে আবার সেই ধারণা দেখতে পাই। তিনি সূচীছিদ্র ক্যামেরা নিয়েও লিখে গেছেন।

হিরোর অনুসরণে প্রতিসরণের সূত্র প্রমাণ করেছিলেন পিয়ের দে ফার্মা (১৬০৭—১৬৬৫ খ্রি)। সপ্তদশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের ইতিহাসে ফার্মা এক উল্লেখযোগ্য নাম। গণিতে সর্বকালের বিখ্যাততম সমস্যাগুলির মধ্যে একটির সঙ্গে তিনি জড়িত; ১৬৩৭ সালে তিনি একটি উপপাদ্যের কথা বলেছিলেন, সেটি প্রমাণ করতে লেগেছে সাড়ে তিনশো বছরের বেশি। আলোকবিজ্ঞানে প্রতিসরণের সূত্র বিষয়ে গবেষণার জন্য তিনি সুপরিচিত। হিরো বলেছিলেন আলো সব থেকে কম পথ যায়, ফার্মা প্রস্তাব করলেন—আলো সব থেকে কম সময়ের পথ বেছে নেয়। তার থেকে তিনি প্রতিসরণ-সংক্রান্ত স্নেলের সূত্রটি প্রমাণ করেন। এই নিয়ে এই অধ্যায়ের পরিশিষ্টে আরো কিছু আলোচনা পাওয়া যাবে।

এই অধ্যায় শেষ করার আগে দুটি যন্ত্রের কথা বলতে হবে। একটির কথা আমাদের গল্পে আগেই এসেছে, দূরবিন বা টেলিস্কোপ। টেলিস্কোপের আবিষ্কর্তা হিসাবে অনেকের নামই আসে, তবে পেটেন্টের দরখাস্ত সবার আগে করেছিলেন হান্স লিপার্শে (১৫৭০—১৬১৯ খ্রি) নামের এক চশমা নির্মাতা। তবে তাঁর পেটেন্ট গ্রাহ্য হয়নি, প্রায় একই সময়ে আরো অনেকেই যন্ত্রটি বানিয়ে ফেলেন। টেলিস্কোপের সাহায্যে গ্যালিলিওর আকাশ পর্যবেক্ষণ আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম দেয় বলে অনেকে মনে করেন। অপর যন্ত্রটি হল অণুবীক্ষণ বা মাইক্রোস্কোপ। এরও প্রথম নির্মাতার নাম আমাদের অজ্ঞাত, তবে গ্যালিলিওর লেখা থেকে দেখা যায় ১৬১০ সালে তিনি টেলিস্কোপকে উল্টে অণুবীক্ষণ হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। অ্যান্টনি ভ্যান লিউভেনহুক (১৬৩২—১৭২৩ খ্রি) এই যন্ত্রে অনেক উন্নতি সাধন করেছিলেন। দূরবিন যেমন আমাদের কাছে মহাবিশ্বের বিশালতাকে উন্মোচিত করেছিল, অণুবীক্ষণও তেমনি দেখিয়েছিল—আমাদের কাছেই আছে এক বিরাট না-দেখা জগৎ। বিজ্ঞানপ্রযুক্তির উন্নতিতে তাই এই দুই যন্ত্রের ভূমিকা বিশাল।

পরিশিষ্ট

রয়মার কর্তৃক আলোর বেগ নির্ণয়

রয়মারের প্রবন্ধ থেকে নেওয়া রেখচিত্র (উৎস: উইকি)

সঙ্গের ছবিটি রয়মারের এক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া। এখানে \(B\) হল বৃহস্পতি, \(C\) ও \(D\) হল গ্রহণের ঠিক আগের ও পরের মুহূর্তে বৃহস্পতির উপগ্রহের অবস্থান, \(A\) হল সূর্য এবং \(F, G, H, L, K\) হল পৃথিবীর বিভিন্ন অবস্থান। পৃথিবী যখন \(F\) থেকে \(G\) বিন্দুতে যায়, অর্থাৎ বৃহস্পতির দিকে যায় তখন দুটি গ্রহণের মধ্যের সময়টা কমতে থেকে, কারণ আলোকে কম দূরত্ব যেতে হচ্ছে। আবার যখন পৃথিবী বৃহস্পতির থেকে সরে যায় অর্থাৎ \(L\) থেকে \(K\) বিন্দুতে যায় তখন দুই গ্রহণের মধ্যের সময়ের পার্থক্য বাড়ে। একবার আবর্তনের জন্য সময়ের পার্থক্য কম, কিন্তু কয়েকটি আবর্তনকে একসঙ্গে ধরে হিসাব করলে সেই পার্থক্য যোগ হতে থাকবে, অর্থাৎ বাড়তে থাকবে।

রয়মারের যুক্তিকে একটু সরলভাবে লেখা যাক। ধরা যাক পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাস হল \(D\), উপগ্রহের আবর্তনকাল হল \(t\) এবং \(c\) আলোর বেগ। তাহলে থেকে পৃথিবী যখন \(H\) থেকে \(E\) বিন্দুতে (অর্থাৎ জ্যোতির্বিদ্যার ভাষায় সংযোগ থেকে প্রতিযোগ বিন্দুতে) যাচ্ছে, তখন যদি দেখা যায় যে \(T_1\) সময়ে উপগ্রহ \(n\) সংখ্যক আবর্তন করে, তাহলে লিখতে পারি \(T_1 = n t + D/c\)

আবার যখন \(E\) থেকে \(H\) বিন্দুতে যায় তখন \(n\) সংখ্যক আবর্তনের জন্য \(T_2\) সময় লাগলে লেখা যায় \(T_2 = n t - D/c\)
সুতরাং, \(T_1 - T_2 = 2 D/c\), বা \(c = 2 D (T_1-T_2)\)
রয়মারের হিসাবে বৃহস্পতির উপগ্রহ আইয়োর জন্য এই সময়ের হেরফের সবথেকে বেশি হয়: বাইশ মিনিট, সুতরাং আলো পৃথিবীর কক্ষপথ পেরোতে বাইশ মিনিট সময় নেয়।

রয়্যাল সোসাইটির পত্রিকায় রয়মারের প্রবন্ধ (উৎস: ইন্টারনেট আর্কাইভ)

নক্ষত্রের অপেরণ ও আলোর বেগ

নক্ষত্রের অপেরণ কাকে বলে? উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে ঠিক মাথার উপরে কোনো নক্ষত্র (\(S\)) থেকে আলো এসে টেলিস্কোপে ঢুকছে। যে সময় আলো টেলিস্কোপের প্রথম (\(p_1\)) থেকে শেষ বিন্দু (\(p_3\))-তে পৌঁছোচ্ছে, সেই সময় টেলিস্কোপ \(T_1\) থেকে \(T_3\) অবস্থানে একটু এগিয়ে গেছে, কারণ পৃথিবী গতিশীল। সেজন্য টেলিস্কোপকে সরাসরি নক্ষত্রের দিকে না তাক করে বরঞ্চ একটু কোণ করে রাখতে হয়, মনে হয় নক্ষত্র \(S'\) বিন্দুতে আছে। আবার ছয় মাস পরে পৃথিবীর বেগ ঠিক বিপরীত দিকে হবে, তখন টেলিস্কোপকে উল্টোদিকে হেলিয়ে রাখতে হবে। একে বলে অপেরণ। আলো \(h\) দূরত্ব অতিক্রম করতে \(h/c\) সময় নেয়, ততক্ষণে টেলিস্কোপ \(v h/c\) দূরত্ব এগিয়ে যাচ্ছে। এখানে \(c\) ও \(v\) হল যথাক্রমে আলো ও পৃথিবীর বেগ। ছবি থেকে দেখা যাচ্ছে \(\tan(\theta) = (v h/c)/h = v/c\)। এখানে কোণের মাপ খুবই ছোট, এত ছোট কোণকে রেডিয়ানে যদি প্রকাশ করি তাহলে \(\tan(\theta) ≈ \theta\)। সেক্ষেত্রে \(c = v/\theta\)।

ব্র্যাডলি অবশ্য ঠিক মাথার উপরের নক্ষত্রের মাপ দিয়ে শুরু করেননি, সেক্ষেত্রে এই অঙ্কটা একটু শক্ত হবে। আধুনিক হিসাবে অপেরণের মান হল \(20.479\) সেকেন্ড, রেডিয়ানে প্রকাশ করলে তা হয় \(9.9285\times 10^{-5}\)। পৃথিবীর গড় বেগ যদি প্রতি সেকেন্ডে \(29.78\) কিলোমিটার ধরে নিই, তাহলে আলোর বেগ বেরোয় প্রতি সেকেন্ডে \(2.99944\times 10^8\) মিটার বা \(299944\) কিলোমিটার। আলোর বেগের আধুনিকতম মাপ হল \(299792\) কিলোমিটার/সেকেন্ড; ব্র্যাডলির পদ্ধতির সঙ্গে তার তফাত মাত্র \(0.05\) শতাংশ বা দু-হাজার ভাগের এক ভাগ। ব্র্যাডলির সময় অবশ্য অপেরণ বা পৃথিবীর বেগের এত নিখুঁত মাপ পাওয়া সম্ভব ছিল না, তাই তাঁর মাপে \(0.4\) শতাংশ ত্রুটি ছিল।

নক্ষত্রের অপেরণের ভিডিও (উৎস: ইউটিউব)

ফার্মার নীতি

ধরা যাক বায়ু থেকে আলোকরশ্মি জলে গিয়ে পড়ছে এবং প্রতিসরিত হচ্ছে। বায়ুর সাপেক্ষে জলের প্রতিসরাঙ্কের মান হল \(\mu\), অর্থাৎ আলোর বেগ বায়ুতে \(c\) হলে জলের মধ্যে হবে \(c/\mu\)। ফার্মা লিখেছিলেন যে ঘন মাধ্যমে আলোর বেগ অপেক্ষাকৃত কম অর্থাৎ জলের প্রতিসরাঙ্কের মান এক অপেক্ষা বেশি। আলো \(A\) বিন্দু থেকে দুই মাধ্যমের বিভেদতলে \(P\) বিন্দুতে পড়ছে, সেখান থেকে \(B\) বিন্দুতে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে যে \(P\) বিন্দুর অবস্থানের উপর \(i\) ও \(r\) কোণের মান নির্ভর করে। আলো \(A\) থেকে \(B\) বিন্দুতে যেতে সময় নেয় \(l_1 /c + l_2/(c/\mu)\)। ফার্মা দেখালেন সব থেকে কম সময় লাগে যে পথে, তার জন্য \(P\)-এর অবস্থান এমন হয় যে \(\sin(i)/\sin(r)\) অনুপাতটির মান ধ্রুবক হয়। প্রতিফলনের ক্ষেত্রে আলো একই মাধ্যম দিয়ে যায়, সুতরাং প্রতিফলনের আগে ও পরে বেগ সমান। তাই দু’টি বিন্দুর মধ্যে পথের দৈর্ঘ্য যখন চরম (অর্থাৎ সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন) হয়, তখন পথের সময়কালও চরম হয়। হিরো ধরেছিলেন আলোর বেগ অসীম, তাই সেখানে সময়ের প্রশ্ন উঠতে পারে না কারণ সেক্ষেত্রে আলো যেতে কোনো সময়ই নেয় না। দেখা যাচ্ছে হিরোর নীতি ফার্মার নীতিরই এক বিশেষ রূপ। ফার্মা এই প্রমাণে যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন তার মধ্যে কলনবিদ্যাতে ভেদ বা ক্যালকুলাস অফ ভেরিয়েশনের বীজ নিহিত ছিল, নিউটন পরে এর সার্থক প্রয়োগ করেন।


No comments

মন খুলে মন্তব্য করুন। আমাদের সময়-সুযোগ মতো মডারেশন হয়, তাই মন্তব্য এই পাতায় ফুটে উঠতে কিছু সময় লাগতে পারে। নইলে নিশ্চিন্ত থাকুন, খুব খারাপ কিছু বা স্প্যাম না করলে, মন্তব্য ঠিক বেরোবে এই পাতায়।