আলোকবিদ্যার ইতিকথা - উন্মেষপর্ব
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
মূল ছবি: সুনন্দ |
আমাদের যে পাঁচটি ইন্দ্রিয় আছে, অর্থাৎ চোখ, কান, জিভ, নাক এবং ত্বক, তার মধ্যে প্রথমটা দিয়েই আমরা বাইরের জগৎ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানতে পারি। একথা এখন সবাই জানেন চোখ হল আলোক সংবেদী, অর্থাৎ চোখের রেটিনাতে আলো এসে পড়লে সেই সংকেত আমাদের মস্তিষ্কে যায়, তাই আমরা দেখতে পাই। আলোই আমাদের সামনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দরজা খুলে দিয়েছে বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।
স্কুলের বইতেও দেখতে পাই—কোনো বস্তু থেকে আলো এসে আমাদের চোখে পড়লে আমরা দেখতে পাই। আলোক রশ্মি কোনদিক থেকে কোনদিকে যাচ্ছে তা তীর চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়। ছোটবেলায় আমি সেটা ভুল করে উল্টো দিকে দিয়েছিলাম। আমার মাস্টারমশাই বলেছিলেন, “এ তো মহাপুরুষ রে, চোখ থেকে জ্যোতি বেরোচ্ছে।” তখন গোটা ক্লাস হেসে উঠলেও পরে জেনেছি এমন ভুলটা আগে অনেকেই করেছিলেন। তাঁরা সবাই যে স্কুলের ছাত্র ছিলেন তা নয়। প্রাচীন গ্রিসের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের মধ্যে একজন প্লেটো (আনু 424-348 খ্রিপূ), আলেকজান্দ্রিয়ায় বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ইউক্লিড (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক) বা জ্যোতির্বিদ টলেমির (100–170 খ্রি) মতো পণ্ডিতরা মনে করতেন যে চোখ থেকে আলো বেরিয়ে কোনো বস্তুতে পড়লে আমরা সেটাকে দেখতে পাই। অন্ধকার ঘরে কেন চোখ থেকে আলো বেরোয় না সে বিষয়ে তাঁদের কাছে কোনো সদুত্তর মেলেনি।
আলো সম্পর্কে প্রাচীন বিজ্ঞানীদের চিন্তার এটাই এক মাত্র উদাহরণ নয়। আলোক বিজ্ঞানের প্রাচীন যুগকে আমরা মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত হাজার বছরকে ধরে নিতে পারি। এই হাজার বছর ছিল ইউরোপে গ্রিক সভ্যতার যুগ, ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরে এথেন্স থেকে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া, বর্তমান তুরস্কের আনাতোলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া পর্যন্ত তা বিস্তৃত হয়েছিল। গ্রিক সভ্যতাতে একদিকে ছিলেন পরমাণুবাদীরা, যাঁরা সমস্ত কিছুকেই পরমাণুর সাপেক্ষে ভাবতেন। বিখ্যাত পরমাণুবিদ ডেমোক্রিটাস (আনু 460-370 খ্রিপূ) মনে করতেন যে বস্তু থেকে আলোর পরমাণু বেরিয়ে এসে চোখের সামনে বায়ুর সংকোচনের মাধ্যমে এক প্রতিবিম্ব গঠন করে, এরপরই সংকুচিত বায়ু চোখের উপর চাপ দেয়, চোখ থেকে মস্তিষ্কে সেই সঙ্কেত যায়। বিখ্যাত দার্শনিক এপিকিউরাস (341-270 খ্রিপূ) মনে করতেন যে প্রতিবিম্ব চোখের মধ্যেই গঠিত হয়। তিনি বলেছিলেন যে বস্তু থেকে আলোর কণা বেরিয়ে এলেও বস্তুর ক্ষয় হয় না, কারণ বায়ু থেকে পরমাণু গিয়ে সেই স্থান পূরণ করে। রোমান কবি ও দার্শনিক লুক্রেটিয়াস (খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক) বলেছিলেন যে সূর্য থেকে আলো ও তাপ কণা রূপে বেরিয়ে আসে।
পরমাণুবাদীরা অবশ্য প্রাচীন গ্রিক দর্শন বা বিজ্ঞানে বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেননি। প্লেটো বলেছিলেন যে চোখের থেকে আলো বেরিয়ে বস্তুতে আঘাত করলে আমরা তাকে দেখতে পাই। প্লেটোর তত্ত্বে দেখাকে অনেকটা হাত বাড়িয়ে বস্তুকে অনুভব করার অনুরূপ মনে করা যেতে পারে। এর পর থেকে এক হাজার বছর ধরে প্লেটোর মতই স্বীকৃতি লাভ করেছিল।
সাধারণভাবে প্রাচীন ধ্রুপদী বিজ্ঞান সম্পর্কে একটা কথা সবসময়েই বলা যায়। সে সময় পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের জন্ম হয়নি-অর্থাৎ পরীক্ষা করে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল তা দেখার কথা কারোর মাথায় আসেনি। শুধুমাত্র তর্কের মাধ্যমেই সে সময় দার্শনিকরা তাঁদের নিজেদের মত সমর্থন ও বিরুদ্ধ মত খণ্ডন করতেন। তাই নানা রকমের পরস্পর বিরোধী মত ধ্রুপদী বিজ্ঞানে স্বচ্ছন্দে স্থান পেয়েছিল।
সমস্ত প্রাচীন সভ্যতাই সম্ভবত বিশ্বাস করত যে চতুর্দিকে যত পদার্থ দেখা যায় সেগুলি কতকগুলি মাত্র মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। অবশ্য সেই এলিমেন্ট বা মৌলিক পদার্থের ধারণা আধুনিক যুগের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ডেমোক্রিটাস বা প্লেটো চারটি মূল এলিমেন্টের কথা ভেবেছিলেন, মাটি, জল, বায়ু ও আগুন। অ্যারিস্টটল তার সঙ্গে ইথারকে যোগ করেন। তাকেই আলোর প্রকৃতি বিষয়ে গ্রিকদের চিন্তার সর্বোচ্চ রূপ ভাবা যেতে পারে। প্রাচীন ভারতেও পঞ্চভূত ছিল ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম। চিনদেশের কল্পনায় পাঁচটা মৌলিক পদার্থ ছিল মাটি, ধাতু, কাঠ, জল ও আগুন। এই আগুন বা তেজকেই আলো বলে ধরে নেওয়া হত।
প্রাচীন যুগে বিজ্ঞানীরা আলোর প্রকৃতি নিয়ে বিশেষ চিন্তাভাবনা করতেন না। সাধারণত কোন পথ দিয়ে আলো যায়, তার প্রতিফলন, প্রতিসরণ এ সমস্ত নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেছেন। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক কারণ সে সময়ের প্রযুক্তিতে এদেরই বিশেষ ভূমিকা ছিল। আয়না বা লেন্স বানাতে প্রতিফলন বা প্রতিসরণ বোঝার দরকার হয়। আলোর প্রতিসরণের জন্য জলের মধ্যে তাকিয়ে দেখলে মনে হয় তলার মাটিটা যেন উপরে উঠে এসেছে। জাহাজ চালাতে গেলে এ বিষয়টা বোঝা দরকার। গ্রিকরা আলোক বিজ্ঞানকে খুবই গুরুত্ব দিতেন তা নিয়ে সন্দেহ নেই। দুহাজার বছর আগে তাঁরা সে বিষয়ে বেশ কয়েকটি বই লিখে ফেলেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব 424 সালে বিখ্যাত নাট্যকার আরিস্তোফেনেসের নাটকে উত্তল লেন্সের কথা পাওয়া যায়। নাটকে যখন ছিল, তখন লেন্সের ব্যবহার নিশ্চয় বেশ প্রচলিত ছিল। লেন্স অবশ্য তারও আগে আসিরিয়া ও মিশরীয় সভ্যতাতেও ব্যবহৃত হয়েছিল। গ্রিকরা এমনকি বক্রতল আয়নার ব্যবহারও জানতেন। আর্কিমিডিস (287-212 খ্রিপূ) অবতল আয়না দিয়ে সূর্যের আলোকে ফোকাস করে দূরের জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিতে পারতেন বলে এক বহু পুরানো গল্প প্রচলিত আছে, তবে তার সত্যতা সন্দেহজনক।
প্লেটোর অ্যাকাডেমি ছিল এথেন্সে। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্য তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। সেনাপতি প্রথম টলেমি মিশরে যে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন তা খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দী পর্যন্ত টিকেছিল। তাঁর চেষ্টাতেই মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রাচীন যুগে আলোকবিজ্ঞানের সব থেকে প্রভাবশালী বই ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার বিজ্ঞানী ইউক্লিডের অপটিক্স অর্থাৎ আলোকবিদ্যা।
ইউক্লিডের জ্যামিতি আমরা সবাই ছোটবেলায় পড়েছি, তার মূল বইটির নাম ছিল এলিমেন্টস। পৃথিবীর ইতিহাসে বাইবেল ছাড়া আর কোনো বইয়ের এত সংস্করণ বা এত ভাষায় অনুবাদ হয়নি। দু-হাজার বছরের বেশি এই বইটি পাঠ্যবই হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। ইউক্লিড কতকগুলি স্বতঃসিদ্ধ থেকে জ্যামিতির অনেকগুলি উপপাদ্য প্রমাণ করেছিলেন। অবরোহী (deductive) যুক্তিজালের সর্বোচ্চ উদাহরণ হল ইউক্লিডের এলিমেন্টস। কিন্তু বিজ্ঞান আরোহী (inductive) যুক্তি মেনে চলে; তার ও অঙ্কের পার্থক্যটা এইখানে যে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ধরে নিতে হয় স্বতঃসিদ্ধগুলি ঠিক, তার জন্য কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণ লাগে না। ফলে তা নিজের দিক থেকে সঠিক হতে পারে কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে হয়তো তা প্রযোজ্য নয়। যেমন ইউক্লিডের পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধটি[১] ঠিক ধরলে সেই জ্যামিতি পাওয়া যায় যেটা আমরা স্কুলে শিখেছি। কিন্তু পরবর্তীকালে গণিতবিদরা দেখান যে পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধটিকে না ধরলেও অন্য একধরনের স্বয়ংসম্পূর্ণ জ্যামিতি পাওয়া যায়, এবং বাস্তব বিশ্ব সেই জ্যামিতিই অনুসরণ করে।
অপটিক্স বইটিও ইউক্লিডের এলিমেন্টসের মতোই কিছু স্বতঃসিদ্ধ থেকে শুরু হয়েছে, কিন্তু তাদের প্রথমটিই ভুল। সেখানে ধরে নেওয়া হয়েছে যে আলো দর্শকের চোখ থেকে নির্গত হয়। তাঁর মতের পক্ষে ইউক্লিড যুক্তি দিয়েছিলেন, মেঝেতে একটা ছুঁচ পড়ে গেলে সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না, কারণ চোখ থেকে আলো বেরিয়ে ছুঁচের মতো ছোট বস্তুর উপরে পড়া শক্ত। তা সত্ত্বেও ইউক্লিডের বইতে আলো বিষয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা পাওয়া যায়। ইউক্লিড প্রথমেই ধরে নিয়েছিলেন আলো সরলরেখায় চলে। অবশ্য তারও আগে প্রাচীন চিনে মো জি (খ্রিস্টপূর্ব 470-390) বা গ্রিসে অ্যারিস্টটলের (খ্রিস্টপূর্ব 384-322) লেখাতে সূচীছিদ্র ক্যামেরার বর্ণনা ছিল। সূচীছিদ্র ক্যামেরার ব্যাখ্যা করতে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে আলো সরল রেখায় চলে। ইউক্লিডের বইতেই প্রতিফলনের সূত্রের প্রথম সন্ধান পাওয়া যায়।
প্রতিফলনের দুটি সূত্র:
- (১) আলোকরশ্মি দুটি মাধ্যমের বিভেদন তলে আপতিত হয়ে প্রতিফলিত হলে আপতিত রশ্মি, প্রতিফলিত রশ্মি ও আপতন বিন্দুতে প্রতিফলকতলের উপর অঙ্কিত অভিলম্ব একই সমতলে অবস্থান করে।
- (২) আপতিত ও প্রতিফলিত রশ্মি অভিলম্বের সঙ্গে একই কোণ তৈরি করে।
ছবিতে \(A\) বিন্দু থেকে প্রতিফলক তলে \(P\) বিন্দুর উপর পড়ে আলো প্রতিফলিত হয়েছে। \(P\) বিন্দুতে প্রতিফলক তলের উপরে অভিলম্ব হল \(PQ\)। সূত্র অনুসারে আপতন কোণ \(i\) ও প্রতিফলন কোণ \(r\) সর্বদা সমান।
আলেকজান্দ্রিয়ার হিরো (10-70 খ্রি) আলোকবিজ্ঞানের যে বইটি লিখেছিলেন তার নাম ক্যাটপট্রিক্স অর্থাৎ প্রতিফলন। কোনো এক বিন্দু থেকে অপর কোনো বিন্দুতে যেতে আলো সব থেকে কম পথ যায়, এই ধরে নিয়ে তিনি প্রতিফলনের সূত্র প্রমাণ করেন। হিরোর অনুসরণ করে আমরা বলতে পারি যে উপরের ছবিতে \(A\) বিন্দু থেকে আলো বেরিয়ে প্রতিফলক তলে প্রতিফলিত হয়ে \(B\) বিন্দুতে যাওয়ার সমস্ত রাস্তাগুলির মধ্যে ন্যূনতম যেটি, তার জন্য আপতন ও প্রতিফলন কোণের মান সমান হবে।
গ্রিকদের ধারণা ছিল আলোর বেগ অসীম, বা তা না হলেও অত্যন্ত বেশি। আকাশের দিকে মুখ করে বন্ধ চোখ খুললেই সূর্য তারা বা নক্ষত্র দেখা যায়। তাদের মতে চোখ থেকে আলো বেরিয়ে তাদের উপর পড়ে ফিরে আসে, তবে তারা দৃশ্যমান হয়। যদিও সূর্য বা তারা কত দূরে আছে তা গ্রিকদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি, কিন্তু দূরত্ব যে অনেক তা নিয়ে সন্দেহ ছিল না। চোখ খোলা মাত্র তাদের দেখতে হলে আলোর বেগ খুব বেশি হতে বাধ্য। হিরো এর স্বপক্ষে অন্য এক যুক্তি দিয়েছিলেন। কোনো বস্তুকে ভূমির সঙ্গে সমান্তরালভাবে ছোঁড়া হল, সে কিছুদূর গিয়ে এক সময় মাটিতে পড়ে যাবে। এখন আমরা জানি যে বস্তুটি একটা অধিবৃত্তাকার পথ ধরে যায়, কিন্তু গ্যালিলিওর আগে এই পথটা ভালোভাবে জানা ছিল না। মনে করা হত যে বস্তুটি কিছুদূর পর্যন্ত সমান্তরাল ভাবে যায়, তারপর মাটিতে পড়ে। হিরো যুক্তি দিলেন যদি বেশি বেগে ছুঁড়ি, তাহলে সে আরো বেশিদূর পর্যন্ত সমান্তরালভাবে সরলরেখা ধরে যাবে। আলো যেহেতু সব সময় সরলরেখাতে চলে, তার বেগ নিশ্চয় অসীম।
আলোকবিজ্ঞানে শেষ যে প্রাচীন গ্রিক বিজ্ঞানীর কথা বলতে হয়, তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার ক্লডিয়াস টলেমি। টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ডের মডেল কোপার্নিকাসের আগে পর্যন্ত সর্বত্র স্বীকৃত ছিল। তাঁর অপটিক্স বইটিও অনেকদিন পর্যন্ত পণ্ডিতদের প্রভাবিত করেছিল, যদিও বইটি আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি। অন্য কিছু বইতে উদ্ধৃতি হিসাবে তার অংশবিশেষ পাওয়া গিয়েছে। টলেমি এক মাধ্যম থেকে অপর মাধ্যমে প্রতিসরণের সূত্র পরীক্ষামূলকভাবে নির্ণয় করার চেষ্টা করেছিলেন। পরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানের সূত্র নির্ণয় আধুনিক যুগে খুব সাধারণ ঘটনা হলেও সে যুগে খুব কম বিজ্ঞানীই সেই পথ বেছে নিয়েছিলেন। সেই কারণে টলেমির এই কাজ খুব উল্লেখযোগ্য। তিনি মেপে বলেছিলেন যে বায়ু থেকে জলে যখন আলো যায়, তখন আপতন ও প্রতিসরণ কোণের অনুপাত সর্বদা সমান। আমরা পরে দেখব যে আলো প্রায় সমকোণে যদি দুই মাধ্যমের বিভেদতলের উপরে পড়ে, তাহলে এই সূত্রটা কিছুটা খাটে।
প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা পতনের পর আরবরা বিজ্ঞানের ধারাকে তুলে ধরেন। ইসলামিয় বিজ্ঞানের সেই স্বর্ণযুগে গ্রিক ও ভারতীয় গ্রন্থগুলি আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। বস্তুত মধ্যযুগে ইউরোপে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চাতে অন্ধকার নেমে এসেছিল, ফলে অধিকাংশ মূল গ্রিক বই হারিয়ে গিয়েছিল। আরবি অনুবাদে সেগুলি সংরক্ষিত হয়েছিল বলেই আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। যে সমস্ত জায়গায় আরবরা মৌলিক অগ্রগতির স্বাক্ষর রেখেছিলেন, তার মধ্যে একটা হল আলোকবিজ্ঞান।
আরবে প্রথম আলোকবিজ্ঞান নিয়ে উৎসাহী হয়েছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানী আল কিন্দি (800-873 খ্রি)। তিনি ইউক্লিড ও অ্যারিস্টটলের তত্ত্বের তুল্যমূল্য বিচার করেছিলেন। অ্যারিস্টটলের তত্ত্বের আলোচনাতে আমরা যাচ্ছি না, শুধু বলি যে সেখানে আলোর সরলরেখায় গমন ধরা হয়নি। আলোর বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে বিচার করে আল কিন্দি ইউক্লিডের মতকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। টলেমির পরে আলোকবিজ্ঞানে প্রথম মৌলিক অবদান আল কিন্দিই রেখেছিলেন, তাঁর বই পরে লাতিন ভাষাতে অনূদিত হয়ে ইউরোপে আলোকবিজ্ঞানের পরবর্তী বিকাশকে প্রভাবিত করেছিল।
আমরা দেখেছি যে টলেমির প্রতিসরণের সূত্র শুধুমাত্র লম্বের কাছাকাছি আপতনের জন্য খাটে। প্রতিসরণের নির্ভুল সূত্রটিকে আমরা স্নেলের সূত্র বলি। 1621 সালে হল্যান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলেব্রর্ড স্নেলিয়াস (1580-1626 খ্রি) সূত্রটি আবিষ্কার করেন। অবশ্য তাঁর পরে ফরাসি বিজ্ঞানী রেনে দেকার্তে (1590-1650 খ্রি) আলাদাভাবে সূত্রটি পুনরাবিষ্কার করেছিলেন, তাই সারা পৃথিবী প্রতিসরণের সূত্রটিকে স্নেলের সূত্র বললেও ফ্রান্সে সেটি দেকার্তের সূত্র নামে পরিচিত।
স্নেলের সূত্র:
আলো যখন এক মাধ্যম থেকে অপর মাধ্যমে যায়, তখন আপতন কোণের (\(i\)) সাইন ও প্রতিসরণ কোণের (\(r\)) সাইনের অনুপাতের মান ধ্রুবক (\(\mu\))। এই ধ্রুবকের মান দুটি মাধ্যমের উপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট হয়। গণিতের ভাষায় লেখা যায় \[\frac{\sin(i)}{\sin(r)} = \mu\]
ছবিতে দেখা যাচ্ছে \(A\) বিন্দু থেকে আলোকরশ্মি দুই মাধ্যমের বিভেদকারী তলের উপর \(P\) বিন্দুতে পড়ছে। \(P\) বিন্দুতে ওই তলের উপর আঁকা অভিলম্বের সঙ্গে আলোকরশ্মি \(i\) কোণ সৃষ্টি করেছে, এই হল আপতন কোণ। তেমনি প্রতিসরিত রশ্মি ওই লম্বের সঙ্গে \(r\) প্রতিসরণ কোণ সৃষ্টি করেছে। ধ্রুবক \(\mu\)-কে বলা হয় প্রতিসরাঙ্ক।
কিন্তু বাস্তবে স্নেলিয়াস বা দেকার্তের থেকে ছয় শতাব্দী আগে ইবন সাল (940- 1000 খ্রি) প্রতিসরণের সূত্রটি আবিষ্কার করেছিলেন। 984 সালে তিনি বক্রতল আয়না ও লেন্স বিষয়ে একটি বই রচনা করেছিলেন, সেখানে লেন্স কর্তৃক আলো ফোকাস করা আলোচনা করতে গিয়ে তিনি এই সম্পর্কটি লিখেছিলেন। কিন্তু আলাদাভাবে সূত্র হিসাবে না লেখার কারণে সেটি বিশেষ পরিচিতি পায়নি। পরে স্নেলিয়াস ও দেকার্তে দুজনেই সেটি পুনরাবিষ্কার করেন।[২]
আলোকবিজ্ঞানে আরবদের অবদানের কথা বললেই যাঁর নাম আসে তিনি সুপরিচিত বিজ্ঞানী আবু আল-হাসান ইবন আল-হাসান ইবন আল-হাইথাম (965-1040 খ্রি), সংক্ষেপে আল-হাইথাম নামে যিনি বিজ্ঞানের ঐতিহাসিকদের কাছে পরিচিত। আল হাইথাম সারা জীবনে দুশোর বেশি বই লিখেছিলেন বলে কথিত আছে যার মধ্যে পঞ্চাশের বেশি আমাদের কাছে এসে পৌঁছোছে। আলোকবিদ্যা ছাড়াও গতিবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিচয় আমরা তাঁর লেখা থেকে পাই। দুশো বছর পরে যখন তাঁর বইগুলি লাতিনে অনুবাদ হয়, তিনি তখন ইউরোপে আল হাজেন নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তাঁর আলোক বিষয়ে গ্রন্থ কিতাব-আল-মঞ্জির প্রকাশিত হয়েছিল 1011 থেকে 1021 সালের মধ্যে, সেই কথা স্মরণে রাখতেই 2015 সালকে আন্তর্জাতিক আলোক বৎসর হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল।
বিজ্ঞানের ইতিহাসে যাঁরা উৎসাহী তাঁরা জানেন আল হাইথামের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল পরীক্ষামূলক বিষয় হিসাবে বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা। মধ্যযুগে ইউরোপীয় বিজ্ঞানে পরীক্ষানিরীক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন রজার বেকন (1220-1292 খ্রি)। কিন্তু তাঁর দুশো বছরেরও বেশি আগে আল হাইথাম আরব বিজ্ঞানে পরীক্ষামূলক পদ্ধতি চালু করেন। কিতাব-আল-মঞ্জির সাত খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডেই তিনি বুঝিয়ে দেন আলোক বিষয়ে নিজের করা নানা পরীক্ষার ফল তাঁর বইতে পাওয়া যাবে। পরীক্ষা করে যা পাওয়া যাবে না, তা তিনি লিখবেন না। যে তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই, তা নিয়ে তিনি চিন্তিত নন।
আলোক বিষয়ে পূর্বসূরী অনেক বিজ্ঞানীর মত নিয়ে তিনি আলোচনা করেছিলেন, কখনো কখনো তা ভুল বলে প্রমাণও করেছিলেন। আগেই দেখেছি যে প্লেটো টলেমি বা ইউক্লিডের মতো বিজ্ঞানীরা মনে করতেন চোখ থেকে আলো বেরিয়ে কোনো বস্তুতে পড়লে তাকে আমরা দেখতে পাই। আল হাইথামই প্রথম বলেন যে বস্তু থেকে আলো এসে চোখের রেটিনাতে পড়ে ও স্নায়ু মারফত মস্তিষ্কে পৌঁছোয়। আরও নানা বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি বলেছিলেন যে আলো যখন বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে যায়, তখন তার বেগ পালটে যায়। মনে রাখতে হবে ইউক্লিড টলেমিসহ অধিকাংশ প্রাচীন বিজ্ঞানীই মনে করতেন যে আলোর বেগ অসীম, কাজেই বিভিন্ন মাধ্যমে তা পাল্টানোর প্রশ্নই আসে না। আল হাইথাম প্রমাণ করলেন চোখ থেকে আলো বেরোনোর প্রশ্ন নেই, স্বাভাবিকভাবেই তার অসীম বেগের পক্ষের গ্রিকদের যুক্তি অচল। তিনি আলোকে কণিকার স্রোত বলে মনে করতেন। লেন্স কেমনভাবে বিবর্ধকের কাজ করে তা তিনি প্রথম ব্যাখ্যা করেন।
আল হাইথাম যে পরীক্ষার সাহায্যে চোখ থেকে যে আলো বেরোয় না প্রমাণ করেছিলেন, তা বেশ উল্লেখযোগ্য। একটি অন্ধকার ঘরের দেওয়ালে একটি ছিদ্র দিয়ে দুটি লণ্ঠনের আলো এসে পড়ছে। দুটি লণ্ঠনের জন্য দেয়ালে দুটি আলোকবিন্দু সৃষ্টি হয়েছে। এবার একটি লণ্ঠনকে নিভিয়ে দিলে একটিই আলোকবিন্দু থেকে গেল। এর থেকে আল হাইথাম সিদ্ধান্ত করেন যে আলো নিশ্চয় চোখ থেকে নয়, লণ্ঠন থেকে বেরোচ্ছে।
আল হাজেনের বই অনুবাদের মাধ্যমে ইউরোপে আসে এবং রজার বেকন, রেনে দেকার্তে, গ্যালিলিও গ্যালিলি, জোহানেস কেপলারের মতো বিজ্ঞানীদের প্রভাবিত করেছিল। তাঁর সমসাময়িক ইবন সিনা (980-1037 খ্রি) ইউরোপে আভিসেন্না নামে পরিচিত হয়েছিলেন। ইবন সিনাও চোখ থেকে আলো বেরোনোর তত্ত্বকে আক্রমণ করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে আলোর বেগ সসীম।
[১] ইউক্লিডের পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধটিকে অনেক ভাবেই লেখা হয়েছে। যেমন একটি হল, দুটি সমান্তরাল রেখার মধ্যে লম্বদূরত্ব সবসময় সমান।
[২] কোনো কোণ \(\theta\)-র মান যদি খুব ছোটো হয়, সেক্ষেত্রে তাকে রেডিয়ানে প্রকাশ করলে লেখা যায় \(\sin(\theta) ≈ \theta\)। লম্বের কাছাকাছি আপতনের জন্য \(i\) ও \(r\) দুই কোণই খুব ছোট, সুতরাং আমরা স্নেলের সূত্রটিকে লিখতে পারি \(\sin(i) / \sin(r) ≈ i/r = \theta\)। টলেমি প্রতিসরণের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছিলেন।
No comments
মন খুলে মন্তব্য করুন। আমাদের সময়-সুযোগ মতো মডারেশন হয়, তাই মন্তব্য এই পাতায় ফুটে উঠতে কিছু সময় লাগতে পারে। নইলে নিশ্চিন্ত থাকুন, খুব খারাপ কিছু বা স্প্যাম না করলে, মন্তব্য ঠিক বেরোবে এই পাতায়।