যা যা আছে

আলোকবিদ্যার ইতিকথা -
তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

মূল ছবি: সুনন্দ

আলো তরঙ্গ এটা মেনে নেওয়ার পরে প্রশ্ন আসে তরঙ্গের ধরনটা আসলে কী? শব্দের বা জলের ঢেউয়ের ক্ষেত্রে মাধ্যমের কণাগুলির কম্পন হয়। তাই এদের বলে যান্ত্ৰিক (mechanical) তরঙ্গ। আমরা হাইজেন্স প্রমুখরা বলেছিলেন আলো ইথার মাধ্যমের তরঙ্গ। কিন্তু ইথার তো নিশ্চয় কোনো সাধারণ বস্তু হতে পারে না। তাহলে আলোক তরঙ্গটা আসলে কী?

এখানে খুব সংক্ষেপে আমরা পদার্থবিজ্ঞানের অন্য এক শাখার ইতিহাস শুনে নিই, তা হল তড়িৎচৌম্বক বিজ্ঞান। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ চুম্বকের আকর্ষণশক্তি সম্পর্কে জানত, তেমনি কিছু কিছু পদার্থ নিজেদের মধ্যে ঘষাঘষি করলে স্থির তড়িৎ উৎপন্ন হয় তাও জানা ছিল। 1785 সালে ফরাসি বিজ্ঞানী শার্ল কুলম্ব (1736-1806) দেখান যে দু’টি আধান বা চার্জের মধ্যে বল তাদের দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতী ও দুই আধানের গুণফলের সমানুপাতী। 1791 সালে লুইগি গ্যালভানি (1737-1798) প্রথম প্রবাহী তড়িৎ আবিষ্কার করেছিলেন, যদিও তিনি ঠিক বিষয়টা বুঝতে পারেননি। 1800 সালে আলেসান্দ্রো ভোল্টা (1745-1827) প্রথম ব্যাটারি বা তড়িৎকোশ বানান, তারপরেই প্রবাহী তড়িৎবিজ্ঞানে গবেষণাতে জোয়ার আসে। হান্স ক্রিশ্চিয়ান ওরস্টেড (1777-1851) ও আঁদ্রে মেরি অ্যাম্পিয়ার (1775-1836) দেখান যে তড়িৎপ্রবাহ চুম্বক ক্ষেত্রের জন্ম দেয়। মাইকেল ফ্যারাডে (1791—1867) দেখান যে কোনো বর্তনীর উপর প্রযুক্ত চৌম্বকক্ষেত্র যদি পরিবর্তন করা হয়, তাহলে বর্তনীতে তড়িৎপ্রবাহ ঘটে, অর্থাৎ তড়িৎক্ষেত্রের জন্ম হয়। জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (1831–1879) তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করেন যে উল্টোটাও সত্যি, অর্থাৎ তড়িৎক্ষেত্রের পরিবর্তন করলেও চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। এর থেকে বোঝা যায় যে তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথক নয়, পরস্পরের সঙ্গে জড়িত।

পরীক্ষাগারে ফ্যারাডের সূত্র যাচাই. (Source: ইউটিউব)

প্রায় একই সঙ্গে নানা পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা যাচ্ছিল যে আলোর সঙ্গে বিভিন্ন পদার্থের তড়িৎ ও চৌম্বক ধর্মের বিশেষ সম্পর্ক আছে। এর মধ্যে আছে ফটো-ভোল্টাইক ক্রিয়া যাতে সূর্যের আলো থেকে বিশেষ ধরনের তড়িৎকোশ বানিয়ে তড়িৎ প্রবাহ পাওয়া সম্ভব হল। মাইকেল ফ্যারাডে দেখালেন যে আলোর সমবর্তন চৌম্বক ক্ষেত্রের উপর নির্ভর করে। জন কার (1824-1907) দেখালেন যে মাধ্যমের মধ্যে আলোর বেগ তড়িৎ ক্ষেত্র প্রয়োগ করে পাল্টানো সম্ভব। ফ্যারাডে অনুমান করেন যে আলো আসলে তড়িৎ ও চুম্বক ক্ষেত্রের কম্পন। তিনি এমনকি ইথারের আদৌ কোনো দরকার আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্ৰকাশ করেছিলেন।

এডিনবরায় ম্যাক্সওয়েলের মূর্তি. (Source: উইকি)

ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম হল আলোর প্রকৃতি আবিষ্কার। ফ্যারাডের থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (1831–1879) দেখান যে তড়িৎ ও চুম্বক ক্ষেত্র আসলে পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। যে কোনো জায়গায় তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্র থাকা সম্ভব। যখন কোনো তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ সেখান দিয়ে যায়, সেখানকার তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্রের মান বাড়ে কমে, এই হল তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্রের কম্পন।

ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব থেকে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের প্রকৃতি সম্পর্কে কী জানা গেল আরো একটু ভালো করে বুঝে নেওয়া যাক। উপরের ছবিতে একটি তীরচিহ্নের সাহায্যে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের অভিমুখ দেখানো হয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে চৌম্বকপ্রাবল্য (Magnetic field)তড়িৎপ্রাবল্য (Electric field) দুইই এই অভিমুখের সঙ্গে লম্বভাবে কম্পিত হয়, তারা আবার পরস্পরের সঙ্গে লম্ব। দু’টি তরঙ্গশীর্ষের মধ্যের দূরত্ব হল তরঙ্গের দৈর্ঘ্য; তড়িৎক্ষেত্র ও চৌম্বকক্ষেত্র এই দুই ক্ষেত্রেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মান সমান। মাক্সওয়েলের তত্ত্ব থেকে যে কোনো মাধ্যমের দু’টি ধর্মের সাহায্যে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের বেগের রাশিমালা নির্ণয় করা সম্ভব হল; ম্যাক্সওয়েল দেখালেন তা হল \(1/\sqrt{\mu\epsilon}\)। এখানে \(\mu\) কে বলে ঐ মাধ্যমের চুম্বকশীলতা বা চৌম্বকভেদ্যতা (Permeability) এবং \(\epsilon\) হল বিদ্যুৎশীলতা বা বৈদ্যুতিকপ্রবেশ্যতা (Permittivity)। শূন্য মাধ্যমের ক্ষেত্রে এই দুই রাশির মান বসিয়ে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের বেগের যে মান পাওয়া গেল, দেখা গেল তা ওই মাধ্যমে আলোর বেগের সমান। অর্থাৎ আলো হল তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ। এর পর থেকে আলোর তরঙ্গ বিষয়ে গবেষণা হল তড়িৎচৌম্বক বিদ্যার অংশ।

উপরের ছবি থেকে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ হল তির্যক তরঙ্গ, কারণ দুই প্রকার কম্পনই অভিমুখের সঙ্গে লম্বভাবে আছে। সাধারণভাবে তড়িৎক্ষেত্রের দিককেই আলোকতরঙ্গের সমবর্তন বলা হয়। রৈখিক সমবর্তনের ক্ষেত্রে তড়িৎক্ষেত্র একই তলে থাকে, চৌম্বকক্ষেত্রও তাই। বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার সমবর্তনের ক্ষেত্রে এই তলদু’টি অভিমুখের সাপেক্ষে ঘুরতে থাকে।

তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের খুব অল্প অংশকেই আমাদের চোখ ধরতে পারে। যে সমস্ত রশ্মি আমরা দেখতে পাই না, অনেকদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এদের অস্তিত্ব সন্দেহ করেননি। অবলোহিত এবং অতিবেগুনি রশ্মির অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়েছিল জ্যোতির্বিদ্যার পর্যবেক্ষণ থেকে। 1800 সালে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্শেল (1738-1822) সৌর বর্ণালীর বিভিন্ন অংশে থার্মোমিটার রেখে উষ্ণতা বৃদ্ধি মাপছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে লাল আলোর পরে বর্ণালীর যেখানটা অন্ধকার, সেখানে উষ্ণতা বৃদ্ধি সব থেকে বেশি। এখন আমরা জানি এর মূলে আছে অবলোহিত রশ্মি যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য লাল আলোর থেকে বেশি। তার ঠিক পরের বছর জার্মান বিজ্ঞানী জোহান উইলহেল্ম রিটার (1776-1810) দেখলেন যে কোনো কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া সৌর বর্ণালীর বেগুনি অংশে খুব দ্রুত হয়, তার থেকেও বেশি দ্রুত হয় বেগুনি আলোর পরের অন্ধকার অংশে। এই ছিল অতিবেগুনি রশ্মি বিষয়ক প্রথম পর্যবেক্ষণ, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেগুনি আলোর থেকে কম।

রেডিও তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সেন্টিমিটারের ভগ্নাংশ থেকে অনেক মিটার পর্যন্ত হতে পারে। 1888 সালে ল্যাবরেটরিতে সেই রকম তরঙ্গ প্রথম বানিয়েছিলেন হাইনরিখ হার্জ (1857-1894)। শুধু রেডিও তরঙ্গ বানালেই হবে না, তাকে ধরে প্রমাণ করতে হবে সত্যিই তার অস্তিত্ব আছে। নিচের ছবিতে হার্জের ব্যবহৃত যন্ত্র দেখানো হল। বাঁদিকের যন্ত্রটিকে বলে স্পার্ক গ্যাপ ট্রান্সমিটার, এটিই হল হার্জের রেডিওতরঙ্গের প্রেরকযন্ত্র। যে মুহূর্তে সুইচ (\(SW\)) খোলা বা বন্ধ হয়, বাঁদিকের কুণ্ডলীর মধ্যে তড়িৎপ্রবাহের পরিবর্তন হয়। ফলে তড়িৎআবেশের জন্য ডানদিকের কুণ্ডলীতে উচ্চ বিভেদের সৃষ্টি হয়, যা \(S\) গ্যাপের মধ্য দিয়ে স্পার্ক বা বৈদ্যুতিক ঝলক পাঠায়। গাড়ির স্পার্কিং প্লাগ এভাবেই কাজ করে। এই ঝলকের সঙ্গে সঙ্গেই রেডিও তরঙ্গের সৃষ্টি হচ্ছে। স্পার্ক গ্যাপ ট্রান্সমিটারের ক্যাপাসিটর বা ধারক (\(C\))-এর মান পরিবর্তন করে রেডিও তরঙ্গের কম্পাঙ্ক পরিবর্তন করা যায়। ডানদিকের বৃত্তাকার তড়িৎবর্তনীটি হল গ্রাহকযন্ত্র বা রিসিভার, এর ব্যাসের উপর নির্ভর করে এ কোন কম্পাঙ্কের তরঙ্গ ধরতে পারবে। যদি প্রেরক ও গ্রাহক যন্ত্রের কম্পাঙ্ক খুব কাছাকাছি হয়, তাহলে রেজ়োন্যান্স বা অনুনাদের সৃষ্টি হবে; সেক্ষেত্রে গ্রাহকযন্ত্রের মধ্যে দিয়ে তড়িৎপ্রবাহের সৃষ্টি হবে ও \(M\) শূন্যস্থান বা গ্যাপে বৈদ্যুতিক ঝলক দেখা যাবে। হার্জ অন্ধকার ঘরে বসে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে সেই ঝলক দেখতে পেলেন। আমরা এখন বলি যে হার্জ উচ্চ কম্পাঙ্কের রেডিও তরঙ্গ সৃষ্টি করেছিলেন।

রেডিওতরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য হার্জের যন্ত্র (উৎস: উইকি)

এই প্রসঙ্গে বলতে হয় জগদীশচন্দ্র বসুর (1858-1937) কথা। জগদীশচন্দ্র হার্জের মতোই এক গ্রাহকযন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর আগের রেডিও তরঙ্গ বিষয়ের সমস্ত গবেষকই একটা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন। স্পার্ক গ্যাপে (\(S\)) যে দু’টি গোলক ব্যবহার করা হয় তারা খুব তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে অসমতল হয়ে যেত, ফলে বৈদ্যুতিক ঝলককে তাড়াতাড়ি বন্ধ করা যেত না। জগদীশচন্দ্র প্লাটিনাম ধাতু দিয়ে বল দু’টি বানালেন। প্ল্যাটিনামের ক্ষয় খুব কম, ফলে সেই সমস্যা তাঁর হয় নি। হার্জের বৃত্তাকার গ্রাহককুণ্ডলীর পরিবর্তে তিনি সর্পিলাকার বা স্পাইরাল স্প্রিঙ বর্তনী ব্যবহার করেছিলেন। তিনিই প্রথম কোনো অর্ধপরিবাহী বা সেমিকন্ডাক্টরকে গ্রাহক হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর তৈরি করা রেডিও তরঙ্গের দৈর্ঘ্য ছিল পাঁচ থেকে পঁচিশ মিলিমিটার, একে আমরা এখন মিলিমিটার তরঙ্গ বলি। তিনি এই তরঙ্গের প্রতিফলন, প্রতিসরণ, সমবর্তন ইত্যাদি ধর্মও পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন।

বোস ইন্সটিটিউটে জগদীশচন্দ্রের ব্যবহৃত যন্ত্র (উৎস: উইকি)

1895 সালে এক্স-রশ্মি আবিষ্কার করেছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেল্ম রন্টজেন (1845-1923)। তিনি ক্যাথোড রশ্মি টিউব নিয়ে কাজ করছিলেন। ক্যাথোড রশ্মি টিউবের ভিতরে খুব নিম্ন চাপে গ্যাসের উপর উচ্চ তড়িৎবিভব প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে গ্যাসের পরমাণুরা আয়ন ও ইলেকট্রনে ভেঙে যায়। এই ইলেকট্রনগুলি উচ্চ তড়িৎ বিভবের জন্য তীব্র বেগে গিয়ে তড়িৎদ্বারকে আঘাত করে, ফলে তার থেকে এক্স-রশ্মি নির্গত হয়। অবশ্য তখনো ইলেকট্রন আবিষ্কার হয়নি, তাই রন্টজেনের পক্ষে এই ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি দেখেন যে এক্স-রশ্মির ভেদনক্ষমতা খুব বেশি, কাগজ, কার্ডবোর্ড, এমনকি মাংসপেশীর মধ্যে দিয়ে সে যেতে পারে, কিন্তু ধাতু বা হাড় তাকে আটকে দেয়। এক্স-রশ্মি ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপরে নিজের ছাপ রেখে যায়। এক্স-রশ্মিতে তোলা রন্টজেনের পত্নীর হাতের ফটোতে হাড় ও আংটির ছবি স্পষ্ট দেখা গেল।

রন্টজেন তাঁর আবিষ্কারের চরিত্র বুঝতে পারেননি, তাই নাম দিয়েছিলেন এক্স-রে অর্থাৎ অজানা রশ্মি। 1906 সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস বার্কলা (1877-1944) দেখান যে এক্স-রশ্মির সমবর্তন ধর্ম আছে। এর পর 1912 সালে জার্মান বিজ্ঞানী মাক্স ফন লউ (1879-1960) দেখান যে এক্স-রশ্মির অপবর্তনও হয়। এক্স-রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব কম, তাই সাধারণ ছিদ্র দিয়ে অপবর্তন দেখা সম্ভব নয়। একমাত্র ক্রিস্টাল বা কেলাসের দুই পরমাণুতলের ভিতরের শূন্য স্থানই এই রশ্মির অপবর্তন দেখাতে সক্ষম।

রন্টজেনের আবিষ্কার অনেক বিজ্ঞানীকেই এক্স-রে নিয়ে কাজ করার প্রেরণা দিয়েছিল। 1896 সালে ফ্রান্সে আঁরি বেকারেল (1852-1908) একটা ড্রয়ারের মধ্যে কিছুটা পটাশিয়াম ইউরানিল সালফেট যৌগের সঙ্গে একটা এক্স-রে প্লেট রেখেছিলেন। পরে প্লেটগুলো পরীক্ষা করে তিনি দেখেন যে পটাশিয়াম ইউরানিল সালফেট থেকে এক নতুন ধরনের বিকিরণ নির্গত হয়, তারা প্লেটে ছাপ রেখে যায়। পরীক্ষা করে বেকারেল দেখেন যে ইউরেনিয়াম থেকেই এই বিকিরণ বেরোচ্ছে। তিনি বুঝেছিলেন এই বিকিরণ এক্স-রশ্মি থেকে আলাদা, কারণ এর আধান বা চার্জ আছে। এক্স-রশ্মি তড়িৎ-নিরপেক্ষ, সে আসলে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ। কিন্তু 1898 সালে ফরাসি বিজ্ঞানী পল উলরিচ ভিলার্ড (1860-1934) দেখালেন যে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে যে শুধু তড়িতাহিত কণা বেরোয় তা নয়। বিকিরণের একটা অংশ আছে যা নিউট্রাল অর্থাৎ নিস্তড়িৎ বা আধানহীন। আর্নেস্ট রাদারফোর্ড (1871-1937) আবিষ্কার করেন তড়িতাহিত বিকিরণকেও দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের বিকিরণ বস্তুর মধ্যে খুব সহজেই আটকে যায়, দ্বিতীয়টার পাল্লা অপেক্ষাকৃত বেশি। রাদারফোর্ড এই দুই রকম বিকিরণের নাম দেন আলফা (\(\alpha\)) ও বিটা (\(\beta\)) রশ্মি। বেকারেল অবশ্য দু’ বছর আগেই দেখেছিলেন বিকিরণের দু’রকম ভেদন-শক্তি আছে, কিন্তু বিকিরণকে দুই ভাগে ভাগ করার কথা তিনি ভাবেননি। 1900 সালে ভিলার্ড দেখান যে নিস্তড়িৎ বিকিরণের ভেদন-ক্ষমতা বিটা রশ্মির থেকেও বেশি। রাদারফোর্ড এই তৃতীয় ধরনের বিকিরণের নাম দেন গামা (\(\gamma\)) রশ্মি। গামা রশ্মির চরিত্র বুঝতে আরও অনেক সময় লেগেছিল। অবশেষে 1914 সালে রাদারফোর্ড এবং এডওয়ার্ড অ্যান্ড্রেড (1887-1971) দেখান যে গামা রশ্মি কোনো তল থেকে প্রতিফলিত হয়। প্রতিফলন হলো আলোর ধর্ম, তাই বোঝা গেল যে গামা রশ্মি হলো একপ্রকার আলো বা তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ।

তড়িৎচৌম্বক বর্ণালী (উৎস: উইকি)

দৃশ্য আলোর মতোই গামা রশ্মি, এক্স-রশ্মি, থেকে শুরু করে রেডিও তরঙ্গ সবাই হল তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ, তাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা। উপরের ছবিটা থেকে তা পরিষ্কার হবে। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব থেকে আলোক তরঙ্গের প্রকৃতি বিষয়ে আমাদের ধারণা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেল। আলো হল তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গ। রেডিও তরঙ্গও তাই, তাদের মধ্যে তফাতটা খালি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মাপে। আগেই বলেছি দৃশ্য আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য 400 থেকে 700 ন্যানোমিটার (\(10^{-9}\) মিটার)। গামা রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য পিকোমিটার (\(10^{-12}\) মিটার) মাপের। অন্যদিকে রেডিও তরঙ্গের ক্ষেত্রে মাপটা হল কয়েক মিটার থেকে কয়েকশো মিটার পর্যন্ত। একটাই সমস্যা রয়ে গেল, তা হল তরঙ্গটা যায় কোন মাধ্যম দিয়ে। অনেক চেষ্টা করেও ইথারের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না। সেই কাহিনি আসবে পরের অধ্যায়ে।

সারা মহাবিশ্ব ছেয়ে আছে যে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ তার আবিষ্কারের গল্প দিয়ে এই অধ্যায় শেষ করা যাক। ম্যাক্সওয়েলের একশো বছর পরে 1964 সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে বেল ল্যাবরেটরির দুই বিজ্ঞানী মাইক্রোওয়েভ ধরার নতুন এক হর্ন অ্যান্টেনা পরীক্ষা করছিলেন। পৃথিবীতে হর্ন অ্যান্টেনা প্রথম বানিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, মিলিমিটার তরঙ্গের ক্ষেত্রেই তিনি তা ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু সবাই তা ভুলে গিয়েছিল। মিলিমিটার তরঙ্গ মাইক্রোওয়েভের মধ্যেই পড়ে। দুই বিজ্ঞানীর যন্ত্রে সবসময় এক সঙ্কেত ধরা পড়ছিল যার উৎস তাঁরা ধরতে পারছিলেন না। তাঁরা ভেবেছিলেন এ হল সার্কিটের নয়েজ বা সহজ কথায় গোলমাল। প্রথমে সন্দেহ করলেন অ্যান্টেনার মধ্যে বাসা বাঁধা দু-টি পায়রাকে। পায়রা সরিয়ে অ্যান্টেনা থেকে তাদের মল পরিষ্কার করেও লাভ হলো না। তাঁরা দেখতে পেলেন যে কোনো বিশেষ উৎস থেকে নয়, আকাশের সব দিক থেকে সমান পরিমাণ সঙ্কেত আসছে। অন্যদের সঙ্গে আলোচনার পরে বোঝা গেল যে এ হল আমাদের মহাবিশ্বের জন্মমুহূর্তের চিহ্ন। মহাবিশ্ব যখন বিগ ব্যাং-এর মাধ্যমে জন্ম নিয়েছিল, তখন তা ছিল প্রচণ্ড উত্তপ্ত। সেই আদি বিকিরণ ছিল গামা রশ্মি। মহাবিশ্ব যত প্রসারিত হয়েছে, তত সে ঠান্ডা হয়েছে। একই সঙ্গে বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই আদি বিকিরণ এখন মাইক্রোওয়েভের রূপ নিয়েছে। একে বলা হয় কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড। মাইক্রোওয়েভ পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা জানি যে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা হল 2.72 কেলভিন, (বা সেন্টিগ্রেডে লিখলে -270.43 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড)। এই আবিষ্কারের জন্য 1978 সালে আর্নো পেনজিয়াস (জন্ম 1933) ও রবার্ট উইলসন (জন্ম 1936) নোবেল পুরস্কারের অংশীদার হয়েছিলেন।


No comments

মন খুলে মন্তব্য করুন। আমাদের সময়-সুযোগ মতো মডারেশন হয়, তাই মন্তব্য এই পাতায় ফুটে উঠতে কিছু সময় লাগতে পারে। নইলে নিশ্চিন্ত থাকুন, খুব খারাপ কিছু বা স্প্যাম না করলে, মন্তব্য ঠিক বেরোবে এই পাতায়।