যা যা আছে

আলোকবিদ্যার ইতিকথা -
তরঙ্গ বনাম কণিকা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

মূল ছবি: সুনন্দ

আলোকবিজ্ঞানে অগ্রগতি হলেও আলোকের প্রকৃতি নিয়ে বিশেষ কোনো নতুন চিন্তাভাবনা আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখতে পাইনি। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে ও অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়াতে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটল। এখানে আমরা দু’টি বইয়ের নাম করতে পারি। প্রথমটি হল ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স (1629-1695) লিখিত Traite de la lumiere বা আলোকবিষয়ক সন্দর্ভ, সেটি প্রকাশিত হয় 1690 সালে। দ্বিতীয় বইটির নাম আলোকবিদ্যা বা অপটিক্স (Opticks), এবং তার লেখক হলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইজাক নিউটন (1643-1727)। অপটিক্সের প্রথম সংস্করণ বেরিয়েছিল 1704 সালে। নিউটনের বিখ্যাত প্রিন্সিপিয়া তিনি লিখেছিলেন লাতিন ভাষাতে, সে সময় একমাত্র পণ্ডিতরাই সেই ভাষা পড়তে পারতেন। অপটিক্স কিন্তু ইংরাজিতে লেখা, তাই বিশেষজ্ঞদের বাইরেও তা প্রচার পেয়েছিল। অবশ্য তার অনেক আগে 1675 সাল থেকেই নিউটন আলোকবিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন।

আলোকবিষয়ক সন্দর্ভ: প্রতিফলন ও প্রতিসরণে আলোর কী হয় – তার ব্যাখ্যা, বিশেষ করে আইসল্যান্ডিক ক্রিস্টালের অদ্ভুত প্রতিসরণ. (উৎস: উইকি)

গতিবিদ্যা বা গণিতশাস্ত্রে নিউটনের অবদানের কথা সবাই জানেন। পদার্থবিজ্ঞানের যে শাখাটিতে নিউটন সব থেকে বেশি হাতেকলমে পরীক্ষা করেছিলেন তা হল আলোকবিজ্ঞান। তিনি আলোর প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। প্রিজমের মধ্যে দিয়ে গেলে সূর্যের আলো নানা রঙে ভেঙে যায়, এই ঘটনাকে বলে বিচ্ছুরণ (Dispersion)। এ থেকে নিউটন প্রমাণ করেছিলেন যে সাদা আলো আসলে বিভিন্ন বর্ণের আলোর সমষ্টি। এখন মনে হতেই পারে যে এ খুব সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু সেই যুগে পরিস্থিতি ছিল আলাদা। নিউটন যে প্রথম প্রিজমের মধ্যে দিয়ে আলো পাঠিয়ে তাকে নানা রঙে ভেঙে যেতে দেখেছিলেন তা নয়, কিন্তু মনে করা হত যে এ হল প্রিজমের ধর্ম, আলোর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। নিউটন দেখালেন যে একই রকম আরো একটি প্রিজম দিয়ে সেই নানা রঙে ভেঙে যাওয়া আলোকে আবার সাদা আলোতে রূপান্তরিত করা যায়। তিনি এও দেখিয়েছিলেন যে বিভিন্ন রঙের আলোর প্রতিসরাঙ্ক আলাদা আলাদা, নীল আলোর প্রতিসরাঙ্ক লাল আলোর থেকে বেশি। নিউটনই প্রথম রামধনুর সঠিক ব্যাখ্যা দেন। বাতাসে ভাসমান জলকণার মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলো প্রতিসরণের ফলে বিভিন্ন রঙে ভেঙে যায় এবং আভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলনের মাধ্যমে আমাদের চোখে আসে, তার ফলে আমরা রামধনু দেখতে পাই। আভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলন বিষয়ে পরের এক অধ্যায়ে আলোচনা আছে।

নিউটনের অপটিক্সের প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ (উৎস: উইকি)

বিভিন্ন রঙের আলোর প্রতিসরাঙ্ক আলাদা বোঝার পর নিউটন সিদ্ধান্ত করলেন যে লেন্স দিয়ে খুব ভালো দূরবিন বানানো সম্ভব নয়। তার কারণ বেগুনি আলো যেখানে ফোকাস হবে, লাল আলো সেখানে হবে না। সুতরাং নিউটন বক্রতল আয়না ব্যবহার করে এক প্রতিফলক দূরবিন বানালেন। নিউটনের ধারণা ছিল ভুল; সরল লেন্স দিয়ে বিচ্ছুরণ আটকানো সম্ভব নয়, কিন্তু বিভিন্ন ধরনের কাচ ব্যবহার করে যে যৌগিক (compound) লেন্স তৈরি হয়, তা দিয়ে সম্ভব। আমাদের ক্যামেরাতে আমরা এই ধরনের লেন্স ব্যবহার করে থাকি। আধুনিক সমস্ত বড় দূরবিনেই অবশ্য নিউটনের অনুসরণে লেন্স নয়, প্রতিফলকই ব্যবহার করা হয়, কিন্তু তার কারণ আলাদা।

আলোর ধর্ম অনুসন্ধানরত নিউটন. (উৎস: Photos.com on Freeimages.com)
সাদা আলোর বিচ্ছরণ ও পুনর্গঠন। (উৎস: ইউটিউব)

আলো যে শক্তির এক রূপ সে বিষয়ে নিউটনের সময় মোটামুটি মতৈক্য গড়ে উঠেছিল। প্রশ্ন ওঠে—তাহলে আলো কেমনভাবে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যায়? শব্দশক্তির ক্ষেত্রে উত্তরটা জানা ছিল। জলের মধ্যে একটা পাথর ফেললে কেমনভাবে ঢেউ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তা আমরা সবাই দেখেছি। বিজ্ঞানের ভাষায় এই ঢেউকে বলে তরঙ্গ। শব্দ হল এক ধরনের তরঙ্গ, যা বাতাসের মধ্যে দিয়ে চলাচল করে। ফ্রান্সে রেনে দেকার্তে, ইংল্যান্ডে রবার্ট হুক (1635 -1703) এবং হল্যান্ডে ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স বললেন আলো হল তরঙ্গ। তবে এই তরঙ্গ কোন মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যায় – সে বিষয়ে তরঙ্গ তত্ত্বের সমর্থকরাও একমত হতে পারেননি। নিউটন আলোকে তরঙ্গ বলে মানতে তৈরি ছিলেন না। তিনি মনে করেছিলেন, যে, আলো হল কণিকার স্রোত। আধুনিক যুগে পিয়ের গ্যাসেন্ডি (1592-1655) প্রথম আলোর কণিকাবাদের কথা বলেন।

আলো কণা না তরঙ্গ, সে বিষয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে সে সময়ের যুক্তিগুলি দেখব। তবে পরবর্তী আলোচনার সুবিধার জন্য তরঙ্গের কয়েকটি সাধারণ বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। জলের উপর ঢেউয়ের দিকে যদি তাকাই, দেখব – কোনো জায়গায় জলটা উঠে এসেছে, আবার কোনো জায়গায় নেমে গেছে। সঙ্গের ছবিতে ঐ রকমই কোনো এক তরঙ্গের ছবি দেখানো হল। এখানে কোনো এক মুহূর্তে একই রেখায় বিভিন্ন বিন্দুতে জলের কণাদের অবস্থান দেখানো হয়েছে। ছবিতে \(A\) ও \(C\)-র মতো বিন্দুদের বলে তরঙ্গশীর্ষ (crest)। তেমনি \(B\)-র মতো বিন্দুদের নাম তরঙ্গপাদ (trough)৷ পর পর দুটি একই অবস্থার বিন্দু—যেমন ছবিতে \(A\) ও \(C\)—তাদের মধ্যের দূরত্বকে বলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য

তরঙ্গশীর্ষ ও তরঙ্গপাদ

সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে আছে বায়ুশূন্য স্থান। তখনো পর্যন্ত আমাদের ধারণা ছিল, যে, কোনোরকম তরঙ্গ চলাচলের জন্য প্রয়োজন হয় একটা মাধ্যমের—ঠিক যেমন শব্দ চলাচল করতে বায়ুর দরকার। তার কারণটাও খুব সোজা, সে সময় আমরা তরঙ্গ বলতে শুধুই যান্ত্রিক তরঙ্গকেই বুঝতাম। তরঙ্গের জন্য মাধ্যমের কণাগুলির কম্পনের দরকার হয়—যেমন শব্দের জন্য বাতাসের কণা বা ঢেউয়ের জন্য জলের কণা প্রয়োজন। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছোয় কেমন করে? আলো যদি কণা হয়, তাহলে এই সমস্যা নেই। বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়লে সে তো আর তার গতির জন্য বাতাসের উপর নির্ভর করে না। বুলেট যদি বায়ুশূন্য স্থান দিয়ে যেতে পারে, আলোর কণিকাও পারবে। নিউটনের সমসাময়িক ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স ছিলেন সে যুগে আলোর তরঙ্গবাদের সব থেকে বড় প্রবক্তা। তিনি কল্পনা করেছিলেন – আলোর যাওয়ার জন্য বায়ুশূন্য স্থান সহ বিশ্বের সর্বত্ৰ ইথার নামের এক মাধ্যম আছে। এ হল অ্যারিস্টটলের ইথারের সামান্য পরিবর্তিত রূপ। তিনি এই ধারণার উপর ভিত্তি করে আলোর তরঙ্গ গতি নিয়ে একটি তত্ত্ব তৈরি করেন, সেখানে আলো হল ইথারের তরঙ্গ। নিউটনও ইথারের কথা এনেছিলেন; এই অধ্যায়ের পরিশিষ্টে দেখব, যে, তিনি এমনকি সেই মাধ্যমে তরঙ্গের কথাও বলেছিলেন, কিন্তু তিনি আলোকে সেই ইথারর তরঙ্গ বলে স্বীকার করেননি। আলো কী ধরনের তরঙ্গ সে বিষয়ে আমরা পরের অধ্যায়ে আলোচনা করব – সেই সময়ে এ বিষয়ে কিছুই জানা ছিল না।

নিউটন বললেন, যে, আলো যখন বায়ু থেকে অপেক্ষাকৃত ঘন কোনো মাধ্যম—যেমন জল বা কাচ—তার মধ্যে ঢোকে, মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে তার বেগ বেড়ে যায়। তাই আলোর প্রতিসরণ ঘটে। অন্য দিকে, শব্দতরঙ্গ ঘন মাধ্যমের মধ্য দিয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি বেগে যায়—এটা জানা ছিল। দেকার্তে বলেছিলেন, আলোও যখন অপেক্ষাকৃত ঘন মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যায়, তখন তার বেগ বেড়ে যায়। আমরা এখন জানি, যে, দু-জনেই ভুল করেছিলেন, আলোর বেগ ঘন মাধ্যমের মধ্যে কমে যায়। আগেই দেখেছি, যে ফার্মা এ বিষয়ে সঠিক মত দিয়েছিলেন, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে ঘন মাধ্যমের ভিতর আলোর বেগ মাপা সম্ভব হয়নি।

নিউটন আলোর সরলরেখা বরাবর গতির উপর জোর দেন। দেওয়ালের ওপাশে কোনো আওয়াজ হলেও আমরা শুনতে পাই, কারণ শব্দতরঙ্গ সামনে কোনো বাধা (যেমন এক্ষেত্রে দেওয়াল) থাকলে তার পাশ দিয়ে ঘুরে যায়। কিন্তু দেওয়ালের ওদিকটা আমরা দেখতে পাই না। নিউটনের যুক্তি – আলো যদি তরঙ্গ হত, তাহলে তো তা দেওয়ালের পাশ দিয়ে ঘুরে আমাদের চোখে এসে পড়ত। তরঙ্গের এই ধর্মকে বলে অপবর্তন (diffraction)। আলো কণিকা হলে তা দেওয়ালের পাশ দিয়ে ঘুরে আসবে না। নিউটন বললেন, আলোর যখন অপবর্তন হয় না, তখন তা নিঃসন্দেহে কণার স্রোত।

পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে নিউটনের বিশাল অবদানের জন্য আলোর কণিকা মতবাদই সে সময় প্রাধান্য পেয়েছিল। পরিশিষ্টে নিউটনের বলয় নিয়ে আলোচনা আছে, সেখানে দেখা যাবে নিউটন কিন্তু আলোর তরঙ্গধর্ম দেখেছিলেন, কিন্তু তাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত বই প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকাতে নিউটনের একটি বিখ্যাত উক্তি, “Hypotheses non fingo” অর্থাৎ আমি কোনোরকম পূর্বানুমান করি না। যদি তিনি পুরোপুরি নিজের কথা পুরোপুরি মেনে চলতেন, তাহলে তিনি তখনই হয়তো আলোর তরঙ্গধর্ম আবিষ্কার করতেন। কিন্তু কণিকাবাদের প্রতি পক্ষপাত আলোকবিজ্ঞানকে প্রায় একশো বছর পিছিয়ে দিয়েছিল। নিউটনের বলয় ব্যাখ্যা করতে তরঙ্গের যে বিশেষ ধর্মটি কাজে লাগে, তা হল ব্যতিচার (Interference)। 1803 সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী টমাস ইয়ং (1773-1829) এক বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে ব্যতিচার দেখিয়েই আলোর তরঙ্গধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। এই পরীক্ষাটা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব, তার আগে আসি অপবর্তনের কথায়।

তরঙ্গের অপবর্তন

আলো তরঙ্গ হলে তার অপবর্তন দেখতে পাওয়া উচিত। কিন্তু আমরা তো সাধারণত আলোকে সরলরেখায় চলতেই দেখি। আসলে তরঙ্গের অপবর্তন দেখতে হলে তরঙ্গের সামনের বাধার মাপ ও তরঙ্গের দৈর্ঘ্য কাছাকাছি হতে হবে। নিচের ছবিতে দেখানো হয়েছে একটি তরঙ্গ এসে পর্দার উপর পড়েছে। দু’টি পরপর রেখা দিয়ে তরঙ্গশীর্ষ দেখানো হয়েছে, অর্থাৎ দু’টি সমান্তরাল রেখার অন্তর হল তরঙ্গদৈর্ঘ্য। হাইগেন্স আলোর গতি ব্যাখ্যা করতে এক নীতির কথা বলেছিলেন, তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে এই প্রতিটি ইথারের কণা আবার আলোকতরঙ্গের জন্ম দেয় যা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। হাইগেন্সের নীতি থেকে বলা যায় ছিদ্রগুলি আলোকউৎস হিসাবে কাজ করে। বাঁদিকের ছবিতে ছিদ্রটির মাপ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের থেকে বড়, ফলে তরঙ্গ প্রায় সরলরেখাতেই যাচ্ছে। ডানদিকের ছবিতে তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও ছিদ্রের মাপ কাছাকাছি, তাই দেখা যাচ্ছে তরঙ্গ ছিদ্রকে অতিক্রম করার পরে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ অপবর্তিত হচ্ছে।

তরঙ্গের অপবর্তনের ভিডিও (উৎস: ইউটিউব)

যে আলো আমরা চোখে দেখতে পাই তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য হল 400 থেকে 700 ন্যানোমিটারের [১] মধ্যে। তুলনা করলে দেখা যায় মানুষের চুলের প্রস্থ হল প্রায় এক লক্ষ ন্যানোমিটার। এত সূক্ষ্ম বাধার ক্ষেত্রেই একমাত্র আলোর অপবর্তন দেখা যাবে, সে কারণেই সাধারণত আমরা ধরে নিই যে আলো সরল রেখায় চলে। অপবর্তন পর্যবেক্ষণ করে সে কথা প্রথম লিখেছিলেন ফ্রান্সেসকো গ্রিমাল্ডি (1618-1663), তবে তিনি যে বিষয়টা পুরোপুরি বুঝেছিলেন তা নয়।

১৮০৩ সালে রয়াল সোসাইটিতে জমা দেওয়া ইয়ং-য়ের পরীক্ষার রেখচিত্র। (উৎস: উইকি)

এবার আসি ব্যতিচারের কথায়। সঙ্গের ছবিতে ইয়ঙের বিখ্যাত দ্বিছিদ্র পরীক্ষাতে আলোকতরঙ্গের একটি সরল রূপ দেখানো হয়েছে। একবর্ণী (monochrome) অর্থাৎ একই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বাঁদিক থেকে একটি অস্বচ্ছ দেওয়ালে পড়ছে। দেওয়ালে দু’টি খুব সরু লম্বাটে ছিদ্র আছে। অপর পাশে রয়েছে একটা পর্দা। আলো যদি কণা হয়, তাহলে পর্দার উপর শুধু মাত্র দু’টি ছিদ্রের ঠিক মুখোমুখি দু’টি জায়গা আলোকিত হত। তুলনা করুন বন্দুকের গুলির সঙ্গে, তাহলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তরঙ্গ তত্ত্ব বলে অন্য কথা। ছিদ্র সরু বলে তা দিয়ে যখন আলো ঢোকে, তখন তা অপবর্তিত হয়ে সব দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সঙ্গের ছবিতে অর্ধবৃত্তাকার রেখাগুলি তরঙ্গশীর্ষ দেখাচ্ছে।

যদি দু’টি ছিদ্র থেকে আসা দু’টি তরঙ্গ এক সঙ্গে পর্দার উপর পড়ে, কোনো জায়গায় দু’টি তরঙ্গশীর্ষ এক জায়গায় গিয়ে পড়বে। সেখানে তাহলে আলোর তীব্রতা খুব বেশি হবে। আবার যেখানে একটি তরঙ্গশীর্ষ অন্য তরঙ্গপাদের উপর পড়বে, সেখানে তরঙ্গের মোট বিস্তার শূন্য অর্থাৎ পর্দায় সেই জায়গা অন্ধকার হয়ে যাবে। পর্দার উপর যেখানে যেখানে দু’টি অর্ধবৃত্ত ছেদ করছে, সেই সেই জায়গায় আলোর তীব্রতা বেশি। সহজে বোঝানোর জন্য এখানে কিছু কিছু বর্ণনা বাদ দেওয়া হল। আগ্রহী পাঠক এই অধ্যায়ের পরিশিষ্টে ইয়ঙের পরীক্ষা সম্পর্কে আরো বেশি জানতে পারবেন। আলো তরঙ্গ হলে পর্দার উপর এইভাবে ক্ৰমান্বয়ে আলো ও অন্ধকারের ঝালর দেখা যাবে। এই ঘটনাকে বলে তরঙ্গের ব্যতিচার। স্পষ্টতই বোঝা যায় ব্যতিচার কণিকার পক্ষে সম্ভব নয়। আলোর দু’টি কণিকা এক জায়গায় পড়ে কখনোই অন্ধকার তৈরি করতে পারবে না। যদি সাদা আলো ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে যে বিভিন্ন রঙের আলো আছে তাদের তরঙ্গশীর্ষ বা তরঙ্গপাদ বিভিন্ন অবস্থানে হবে। পর্দার উপর তাহলে লাল আলোর জন্য দু’টি তরঙ্গশীর্ষ যেখানে পড়বে, বেগুনি আলোর জন্য পড়বে অন্য জায়গায়। ফলে পর্দার উপর নানা রঙের আলোর ঝালর দেখা যাবে। নিউটন সাবানের বুদ্বুদে নানা রঙের আলোর খেলা নিয়ে চিন্তা করেছিলেন, সেখানেও এইটাই হয়। বুদ্বুদের দু’টি দেওয়াল থেকে প্রতিফলিত আলোর মধ্যে ব্যতিচারের ফলে নানা রঙের খেলা দেখতে পাওয়া যায়।

টমাস ইয়ং (উৎস: উইকি)

আলো যে তরঙ্গ, ইয়ঙের পরীক্ষার পর তা প্রমাণিত হল। প্রাথমিক ভাবে নিউটনের মতাবলম্বীরা বাধা দিলেও আস্তে আস্তে এই মত সকলেই মেনে নেন। আর কোনো সন্দেহ প্ৰায় একশো বছর কারো মনে আসেনি। ইয়ং আরও দেখালেন যে নানা রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা।

অপর একটি তরঙ্গধর্ম, যার নাম সমবর্তন (polarization) – সেটিও আলোক তরঙ্গের ক্ষেত্রে দেখা গেল। সব রকম তরঙ্গের সমবর্তন হয় না। দু-ধরনের তরঙ্গ হওয়া সম্ভব। পুকুরে পাথর ফেললে যে ঢেউ ওঠে, তা যায় সামনের দিকে, কিন্তু জলের কণারা উপরে নিচে নড়াচড়া করে। যে সব তরঙ্গের ক্ষেত্রে মাধ্যমের কণাগুলি এভাবে তরঙ্গের অভিমুখের সঙ্গে লম্বভাবে চলাচল করে। তাদের বলে তির্যক তরঙ্গ। শব্দের ক্ষেত্রে বায়ুর অণুগুলি শব্দ তরঙ্গের গতির সঙ্গে সমান্তরালভাবে নড়াচড়া করে। এই ধরনের তরঙ্গকে বলে অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ। একমাত্র তির্যক তরঙ্গেরই সমবর্তন হয়। হাইগেন্স বিশ্বাস করতেন আলো হল অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ, আলো যেদিকে যায় ইথারের কণাগুলি সেইদিকে পরপর এক অপরকে ধাক্কা মারে। অবশ্য পরবর্তীকালে ফ্রেনেল ও ম্যাক্সওয়েলের গবেষণা থেকে প্রমাণ হয়েছে যে আলো আসলে তির্যক তরঙ্গ। আলোকতরঙ্গের প্রকৃতি উন্মোচনের কথা আসবে পরের অধ্যায়ে। হাইগেন্সের নীতির কথা আগেই বলেছি, তার থেকে আলোকের অপবর্তন, প্রতিফলন ইত্যাদি ব্যাখ্যা করা যায়।

পরিশিষ্ট

ব্যতিচার ও ইয়ঙের পরীক্ষা

শুধু আলোকবিদ্যা নয়, ইয়ঙের দ্বিছিদ্র পরীক্ষা পদার্থবিজ্ঞানের সর্বকালের অন্যতম বিখ্যাত পরীক্ষাগুলির মধ্যে পড়বে। নিচের ছবিতে ছিদ্র দু’টি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, তাদের মধ্যের দূরত্ব হল \(d\)। একটি একবর্ণী (অর্থাৎ নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের) আলোকউৎস থেকে আলো ওই দুই ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে গিয়ে \(L\) দূরত্বের পর্দাতে পড়ছে। প্রথম ছিদ্র থেকে আলো পর্দার কেন্দ্র থেকে \(x\) দূরত্বের বিন্দুতে যেতে আলোকে \(\sqrt{L^2 + (x-\frac{d}{2})^2}\) পথ যেতে হয়। দ্বিতীয় বিন্দুর ক্ষেত্রে এই দূরত্বটা হল \(\sqrt{L^2 + (x+\frac{d}{2})^2}\)। তাহলে দুই পথের পার্থক্য পাওয়া সহজ। এখন \(d\) বা \(x\) যদি \(L\)-এর থেকে অনেক ছোট হয়, তাহলে পথের পার্থক্যকে লেখা যায় \(x \frac{d}{L}\).

উৎস: উইকি

এই পথদৈর্ঘ্যের পার্থক্যের মান যদি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (\(\lambda\)) পূর্ণ সংখ্যার গুণিতক হয়, তাহলে দু’টি তরঙ্গশীর্ষ (বা তরঙ্গপাদ) একে অপরের উপর পড়ে সংপোষী ব্যতিচার (Constructive interference) ঘটবে—আগেই দেখেছি, যে, এইরকম ক্ষেত্রে সেই বিন্দুকে উজ্জ্বল দেখাবে। তাহলে সংপোষী ব্যতিচারের শর্ত হল \[\frac{x d}{L} = n\lambda, ~~~~~~ n = 0, 1, 2, \ldots\] ঠিক তেমনভাবে বিনাশী ব্যতিচারের (Destructive interference) ক্ষেত্রে এক তরঙ্গশীর্ষ অপর তরঙ্গপাদের উপর পড়বে। দু’টি পরপর তরঙ্গশীর্ষ ও তরঙ্গপাদের মধ্যের দূরত্ব হল\(\lambda/2\)। সুতরাং বিনাশী ব্যতিচারের শর্ত হল \[\frac{x d}{L} = \left(n+\frac{1}{2}\right)\lambda, ~~~~~~ n = 0, 1, 2, \ldots\] ইয়ঙের পরীক্ষাতে পর্দার উপর ঝালর দেখা যায়, অর্থাৎ আলো ও অন্ধকার রেখা বা পটি পরপর দেখা যায়। এর ব্যাখ্যা একমাত্র ব্যতিচারের মাধ্যমেই সম্ভব। পর্দার উপরে বিভিন্ন বিন্দুতে \(x\)-এর মান আলাদা আলাদা, ফলে কোথাও সংপোষী আবার কোথাও বিনাশী ব্যতিচার হবে। পরপর দু’টি পটির মধ্যে দূরত্ব মেপে উপরের রাশিমালা থেকে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ণয় করা সম্ভব।

একটা প্রশ্ন থেকেই যায় – এতদিন কেন ব্যতিচার দেখা যায়নি, বা আমরা সাধারণভাবে দু’টি আলোর মধ্যে ব্যতিচার দেখি না কেন। তার কারণ হল দু’টি ভিন্ন আলোকউৎসের মধ্যে দশার পার্থক্য এলোমেলো ভাবে পাল্টাতে থাকে। সে কারণে তাদের মধ্যে ব্যতিচার দেখা সম্ভব নয় – কোনো এক মুহূর্তে হয়তো সংপোষী ব্যতিচারের শর্ত পূরণ করল, ঠিক তার পর মুহূর্তেই সেই শর্ত আর মিলল না। সেই কারণে আমরা একটা গড় ঔজ্জ্বল্য দেখতে পাই। ইয়ং দু’টি ছিদ্রকে একটিই আলো দিয়ে আলোকিত করেছিলেন, ফলে দুই ছিদ্র থেকে নির্গত আলোর মধ্যে দশার পার্থক্য পাল্টায়নি।

নিউটনের বলয় ও আলোকতরঙ্গ

কয়েকশো বছর পরে আজ দাঁড়িয়ে নিউটন কোথায় ভুল পথে গিয়েছিলেন তা বলা সহজ। সে যুগের কথা আলাদা, তখন তরঙ্গ প্রকৃতির পক্ষে নিশ্চিত প্রমাণ কিছু ছিল না। কিন্তু নিউটনের অপটিক্সের কিছু কিছু জায়গা পড়ে সত্যিই মনে হয় যে তিনি ইচ্ছা করলেই আলোকতরঙ্গে র কথা বলতে পারতেন। পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকস্তরের ছাত্রদের খুব পরিচিত এক পরীক্ষা হল নিউটনের রিং বা বলয়। একটা সমতল কাচের প্লেটের উপরে একটা লেন্স রাখা হল যার এক পিঠ সমতল, অন্যটি উত্তল, এই উত্তল পিঠটি প্লেট স্পর্শ করে আছে। উপর থেকে একবর্ণী আলো ফেললে দেখা যাবে সমকেন্দ্রিক অন্ধকার ও আলোর বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে। রবার্ট হুক আগে এই ঘটনা দেখলেও নিউটনই প্রথম এই নিয়ে গভীরভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন ও বিস্তারিত লিখেছিলেন, তাই এদের নাম নিউটনের বলয়

নিউটনের বলয় আর তা দেখার পদ্ধতি (উৎস: লিঙ্ক)

আলোকে তরঙ্গ ধরলে ব্যাখ্যা খুব সহজ। দুইটি কাচের মধ্যে বায়ুর স্তর সমান চওড়া নয়, কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে ক্রমশ বাড়তে থাকে। উপরের কাচের গোলকাকার তল থেকে আলোর এক অংশ প্রতিফলিত হয়, আবার এক অংশ নিচের সমতল কাচ থেকে প্রতিফলিত হয়। এই দ্বিতীয় অংশের আলো বেশি পথ যাচ্ছে, তাই তার দশা প্রথম অংশে আলোর থেকে আলাদা। এই দুই প্রতিফলিত আলোর মধ্যে দশা প্রভেদ শূন্য (বা\(n \times 360^{\circ}\), \(n\) যে কোনো পূর্ণ সংখ্যা) হয়, তাহলে দুই আলো একে অপরের তীব্রতা বাড়ায়, অর্থাৎ সংপোষী ব্যতিচার ঘটে। আবার যদি দশার পার্থক্য যদি \(180^{\circ}\) (বা \((2 n + 1 )\times 180^{\circ}\), \(n\) যে কোন পূর্ণ সংখ্যা) হয়, তখন দুই আলো কাটাকাটি করে শূন্য হয়ে যায়, তখন বিনাশী ব্যতিচারের ফলে জায়গাটি অন্ধকার দেখায়। বায়ু স্তরের পুরুত্ব ক্রমাগত পাল্টাতে পাল্টাতে যায় বলে দশার পার্থক্যও পাল্টাতে থকে, ফলে পরপর বিনাশী ও সংপোষী ব্যতিচার দেখা যায়। এর ফলে আলোকিত ও অন্ধকার বলয়ের সৃষ্টি। একবর্ণীর বদলে সাদা আলো ফেললে নানা রঙের বলয় দেখা যায়। বিভিন্ন রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা, তাই তাদের বিনাশী বা সংপোষী ব্যতিচারের জন্য আলাদা আলাদা বায়ুস্তরের পুরুত্ব লাগে। হয়তো নীল আলোর যেখানে বিনাশী ব্যতিচার হয়, ঠিক সেখানেই লাল আলোর সংপোষী ব্যতিচার হয়; তাই বিভিন্ন রঙের বলয় দেখা যায়। নিউটন তাও দেখেছিলেন। সাবানের বুদ্বুদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা হয়।

নিউটন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, “Nothing more is requisite for putting the Rays of Light into Fits of easy Reflexion and easy Transmission, than that they be small Bodies which by their attractive Powers, or some other Force, stir up Vibrations in what they act upon, which Vibrations being swifter than the Rays, overtake them successively, and agitate them so as by turns to increase and decrease their Velocities, and thereby put them into those Fits.” (Opticks, 4th Edition, সে যুগের বানান ও লিখনরীতি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।) অর্থাৎ, আলোর কণা (ইথার) মাধ্যমে কম্পনের সৃষ্টি করে, সেই কম্পনজাত তরঙ্গের বেগ কণার বেগের থেকে বেশি, সেই তরঙ্গ কণাদের বেগের পরিবর্তন এমনভাবে ঘটায় যে তারা কখনো শুধু প্রতিফলিত হয়, কখনো বা শুধু প্রতিসারিত হয়। এর ফলেই আলো অন্ধকার বলয়ের সৃষ্টি। নিউটন ইথার তরঙ্গের কথা বলছেন, আলোর ক্ষেত্রে তার ভূমিকার কথাও বলছেন, কিন্তু আলোকে তরঙ্গ বলে মানতে তাঁর আপত্তি!


[১]ন্যানোমিটার হল এক মিটারের একশো কোটিভাগের একভাগ। অঙ্কের ভাষায় বললে \(1\) ন্যানোমিটার = \(10^{-9}\) মিটার

No comments

মন খুলে মন্তব্য করুন। আমাদের সময়-সুযোগ মতো মডারেশন হয়, তাই মন্তব্য এই পাতায় ফুটে উঠতে কিছু সময় লাগতে পারে। নইলে নিশ্চিন্ত থাকুন, খুব খারাপ কিছু বা স্প্যাম না করলে, মন্তব্য ঠিক বেরোবে এই পাতায়।